আমেরিকার পথে

সাউদিয়া এয়ারের টিকেট সবচেয়ে সস্তায় পেলাম। সেটাই কিনলাম। আগের রাতে ফাইনাল আড্ডা মেরে শাহবাগ থেকে বাসায় ফিরছিলাম আমি আর সোহেল। অনেক রাত তখন। বারোটা তো হবেই। লালমাটিয়ার কাছে এসে হাইজ্যাকারের পাল্লায় পড়ে পাসপোর্ট, টিকেট, ট্রাভেলার্স চেক সব প্রায় হারাতে বসেছিলাম। কপাল গুনে বেঁচে গেলাম আচম্বিতে এক গার্ডিয়ান এঞ্জেল এসে আবির্ভুত হওয়ায়।

১৯৮৯ সাল। সেপ্টেম্বর মাস। আমেরিকায় যাবো। সকাল বেলায় এয়ারপোর্টে যেতে হবে। সকালে বাসেত এলো। সেও মনে হয় আমার সাথে গিয়েছিলো এয়ারপোর্ট পর্যন্ত।

ইমিগ্রেশন পার হয়ে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ বলে প্লেইনে উঠে বসলাম। জীবনে এই প্রথম আমি লং রুটের বড় প্লেইনে উঠেছি। প্লেইন এত বড় হয়, এত মানুষ ধরে, এটা আমার কল্পনার অতীত ছিল।

আরব দেশের বিমান হলেও হিজাব পরা এয়ার হোস্টেস না, লম্বা, তন্বী ফরাসী মেয়ে, স্কার্ট পরা হাই হিল পায়ে, সুগন্ধ ছড়ায়ে সিটের মাঝের আইল দিয়ে বার বার আসা যাওয়া করেছে। প্রতিবার বাতাসের ঝটকার সাথে তার সুগন্ধি পারফিউমের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। চোখে চোখ পড়লে মিষ্টি হেসে মাথা নোয়াচ্ছিল। তার দেখা দেখি আমারও যে মৃদু হেসে নড করা দরকার ছিলো। কিন্তু সেই সৌজন্য জ্ঞান তখনো রপ্ত করা নাই। তার বদলে উল্টা অসভ্যের মত চোরা চোখে তাকিয়ে দেখছিলাম মেয়েটাকে।

না দেখে উপায় কি ! ঢাকার রাস্তায় তো আর হর রোজ এমন সুন্দরী বিদেশিনী দেখি নাই। কদাচিৎ দেখলেও অনেক দুর থেকে দেখেছি। আর এখন কিনা এক হাত দুর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোখ তো যাবেই।

যাত্রী বোঝাই করে প্লেইন ছেড়ে দিলো। আরবি, ইংরেজিতে যাত্রীদেরকে শুভেচ্ছা জানালো নারী কণ্ঠ। একটু পর সেই মেয়েটা ট্রলি ঠেলে পানীয় নিয়ে এলো।

আমাকে জিজ্ঞেস করে – তুমি কি ড্রিংক করবে !

ড্রিংক বলতে বুঝি মদ খাওয়া। আর কিছু না। পানি, কোক ফান্টা, চা কফিও যে ড্রিংক এইটা তো মাথায় আসে নাই।

আসবে কি করে ! শুনা কিংবা বলার চর্চা নাই আমাদের জগতে। কাউকে বলতে শুনি নাই সে ওয়াটার ‘ড্রিংক’ করে।

মেয়েটার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলি – আই এম মুসলিম। আই ডোন্ট ড্রিংক।

ড্রিংক করি না, কথাটা একদম ডাহা মিছা কথা। বিদেশে যাচ্ছি,তাও আবার আরব দেশের প্লেইনে। তাই নিজেকে ভাল মানুষ বুঝানোর জন্য হারাম জিনিস মদ টদ খাই না, বুঝাতে চাইলাম আর কি।

সে বুঝতে পেরেছে আমি ভুল বুঝেছি। মৃদু হেসে বলে – নো, নট হার্ড ড্রিংক্স। ডোন্ট ইউ ওয়ানা ড্রিংক এনি সোডা !

কি বলে এসব ! সোডা কেমন করে খায় ? সোডা দিয়ে তো কাপড় ধোয় শুধু। মাথা নেড়ে দিলাম ডাইনে বামে। মুখে কিছু বলি না। কি বলবো আর কি বুঝে ফেলবে এই ভয়ে।

কিছু না বলে চুপ করে ট্রলির দিকে তাকাই। দেখি সব সফট ড্রিংক আছে ওখানে থরে থরে সাজানো। এবার হাত বাড়িয়ে সেভেন আপের ক্যানের দিকে দেখিয়ে বললাম – ওটা চাই।

সে শুধু বলল – ওহ ইউ ফাইনালি ওয়ান্ট এ সোডা।

এইবার বুঝে নিলাম ওরা সফট ড্রিন্ককে সোডা বলে। জীবনে প্রথম শুনলাম এই টার্ম।

সোডা খেলাম। আবার চেয়ে নিয়ে আরেক রকম খেলাম। কিছুক্ষণ পর খাবার সার্ভ করতে এলো ভিন্ন হোস্টেস। দুনিয়ায় তখনো হালাল, হারাম শব্দগুলি ব্যবহার হত না খাবার খাওয়ার সময়। শুনি নাই দেশে। বিদেশী প্লেইনেও বলে নাই। একটা ট্রেতে করে সাজানো ছোট্ট বাটিতে ভাত, মুরগী দিলো। এক নিমিষে খেয়ে ফেললাম। পেটের এক কোণাও ভরে নাই। সাথে দেয়া বাকি হাবিজাবি সব খেয়ে ফেললাম। সবই ভাল লাগলো খেতে।

জার্নি কত লম্বা হবে, কত ঘণ্টা এক সিটের ভিতর কুঁকড়ে বসে থাকতে হবে, সেটা একদম বুঝি নাই আগে। শুরুতে ভাল লাগলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে আর আমার উচ্ছ্বাসের ব্যাটারি ডাউন হতে শুরু করেছে।

প্রায় সাত ঘণ্টা পরে রিয়াদে এসে পৌঁছুল ফ্লাইট। আমেরিকার দূরত্ব সম্বন্ধে আমার জ্ঞান অতীব স্থূল ছিল। তার উপর এতক্ষণ শরীরের লম্বা খাঁচাটা ছোট্ট একটা সিটে বসিয়ে রেখে, জেগে ঘুমিয়ে আমার সময় জ্ঞান, দিনক্ষণ সব ওলট পালট হয়ে গেছে। আমি ভেবেছি নিউইয়র্কে পৌঁছে গেছি। সবাই প্লেইন থেকে নেমে যাচ্ছে ব্যাগ বুগ নিয়ে। আমিও নামলাম।

নাহ, আমাকে কষ্ট করে কিছু খুঁজতে হয় নাই। প্লেইনের গেইট থেকে এয়ারপোর্টের আরবি মানুষেরা আমার এবং অনেকের পাসপোর্ট নিয়ে চেক করলো। তারপর কোন মোলায়েম স্বরে না, কর্কশ আরবি ভাষায় হুকুম করে অনেকটা গরু ছাগল খেদানোর মত করে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল।

টিকেট দেখিয়ে বললাম, আমি নিউইয়র্কে যাবো।

লম্বা জুব্বা পরা বেদুঈন দামড়াটা বিরক্ত চাহনি দিয়ে বলে – নো টক। জাস্ট ওয়াক।

পাসপোর্ট ভিসা চেক করে একদল মানুষকে আলাদা করে ফেললো। বাকিরা যারা শ্রমিক হিসাবে গেছে তাদেরকে আরেক লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখল। আমাকে আরো কয়েকজনের সাথে ছোট একটা রুমে ঢুকিয়ে রীতিমত পুরো শরীরে হাত দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চেক করলো। মুখে কোন সরি, কিংবা প্লিজ জাতীয় শব্দের ব্যবহার ছিল না ওদের। সেই থেকে এই জাতের প্রতি আমার অশ্রদ্ধা জমতে শুরু করলো। পাসপোর্ট নিয়ে গেলো। সিকিউরিটি গেইটে আবার চেক করলো। ব্যাগ থেকে সব বের করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে তারপর বলে, এবার ঢুকিয়ে নাও। আবার নিজেরা হাসাহসি করছে। এসব দেখে আমি সিমপ্লি তাদেরকে মন থেকে ঘৃণা করা শুরু করে দিলাম।

আরবদের প্রতি আমার সেই মনোভাব আর কোন দিন বদলায় নাই। এখনো তাদের দেখলেই আমার গা জ্বলে উঠে। তিন ঘণ্টার বেশী সময় অপেক্ষা করতে হল। তারপর আবার বোর্ডিং এর পালা, আবার চেকিং শুরু। আবার হেনস্থা। খুব অপমান লাগলো। কিছু করার নাই। নীরবে সয়ে প্লেইনে উঠলাম এক সময়।

আবার যাত্রা। আবার নামলো প্লেইন। এবার জেদ্দায়। আবার হেনস্থা। রাগে দুঃখে গা জ্বলছিল। মুখে কিছু না বলে সয়ে গেলাম।

শেষে আমেরিকার পথে উড়াল দিলো জাম্বো জেট। হায় হায়, সেই প্লেইন উড়ছে তো উড়ছেই। কত ঘণ্টা পার হল, কিছু বুঝি নাই। শুধু মনে হয়েছে দিনের পর দিন ধরে উড়ছে সেটা।

অনেকবার খাবার দিয়েছে। কিন্তু খেতে আর ভাল লাগছিলো না। গলা দিয়ে নামছে না। মনে মনে শুধু ভাবছিলাম, কি দরকার ছিল এমন আজাব সয়ে আমেরিকা যাওয়ার। যাওয়ার আগেই আমার এই করুন অবস্থা, ওখানে না জানি আরো কত কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে, কে জানে !

হটাৎ শুনতে পেলাম, পাইলট বলছে আমেরিকার আকাশে পৌঁছে গেছে তারা। আর পনের মিনিট পরে ল্যান্ড করবে। শুনে কিছুটা শান্তি পেলাম। যদিও মনের ভিতর ভয়ে ধুকপুক করছে, আমেরিকার ইমিগ্রেশনে নাকি মানুষ পছন্দ না হলে, সন্দেহ করলে ফেরত পাঠিয়ে দেয় ঢুকতে না দিয়ে। ভিসা ইস্যু করলেই কেউ নিশ্চিতভাবে ঢুকতে পারবে এমন কোন কথা নাই – এমনটাই শুনে এসেছি।

প্লেইন ল্যান্ড করলো। মানুষ নামছে। সবাই ক্লান্ত। ঝড়ো কাকের মত চেহারা সবার। আমার মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুলের পাহাড় এলোমেলো হয়ে বিতিকিচ্ছিরি হয়ে গেছে। এই চুল সামলাতে হলে পানিতে ভিজিয়ে মোটা ব্রাশ দিয়ে অনেকক্ষণ লাগিয়ে আঁচড়াতে হয়। এখন সেই সুযোগ নাই।

যা হওয়ার হবে। নেমে গেলাম। ডিফারেন্ট টাইম জোনে কম ঘুমিয়ে এত টায়ার্ড যে নিজেকে একদম মাতালের মত লাগছিলো।

আরেব্বাহ, আমেরিকার ইমিগ্রেশনের মানুষগুলি দেখি আরবিদের মত চাঁড়াল না। বেয়াদব তো নইই। জীবনে প্রথম কেউ আমাকে ‘স্যার’ বলে ডেকে লাইনে দাঁড় করালো। যে কাউন্টারে ডাক পড়ল, সেই হ্যান্ডসাম স্মার্ট ইমিগ্রেশন অফিসার ও দেখি আমারে স্যার বলে সম্বোধন করছে।

ঘটনা কি ! ( অনেক পরে জেনেছি, এটা নিছক ভদ্রতা ছাড়া আর কিছুনা )।

স্যার ডেকেও তার কাজ সে ঠিকই করলো কোন ছাড় না দিয়ে। ভিসা ঘষে মেজে দেখল। লাল ঘরে পাঠাল। চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেছিলো ভয়ে। যাহ, এই বুঝি আমাকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতেছে।

কিন্তু না, রুটিন চেক ওসব।

কিছুক্ষণ পরে সিল মেরে পাসপোর্ট হাতে দিয়ে বলে -‘ওয়েলকাম টু আমেরিকা, মিঃ হাই। হোপ ইউ উইল এঞ্জয় ইউর স্টে উইথ আস।’

ঢাকা থেকে রওনা হয়েছি তেরো তারিখ সকালে। আমেরিকায় এসে পৌঁছেছি তেরো তারিখ সকালে – এইটা কেমন করে হল, আমার মাথায় ঢুকতে বেশ ঝামেলা হয়েছে। পরে বুঝলাম টাইম জোনে বাংলাদেশে এগিয়ে আছে। লাগেজ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি মাশুক দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে নিতে এসেছে। ওকে দেখে আমার ধড়ে জান ফিরে পেলাম যেন।

মাশুকের সাথে হেঁটে গাড়ির দিকে গেলাম। তার সাথে আরেক ভদ্রলোক আছে। পার্কিং লটে গিয়ে যে গাড়ির সামনে গিয়ে মাশুক দাঁড়ালো, দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। একদম ছয় নম্বর বাসের সমান লম্বা একটা গাড়ি। এতো বড় গাড়ি মানুষ কেমনে চালায় ! সাথের মানুষটা ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। পয়লা ভেবেছি, উনি বোধ হয় মাশুকের ড্রাইভার। ইয়া আল্লাহ, মাশুকের এতো বড় গাড়ি আছে ! শালা নিশ্চয় অনেক বড়লোক হয়ে গেছে।

গাড়িতে উঠার পর আমার জন্য আরো সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো। ভেতরটা দেখতে একটা ছোট খাটো লিভিং রুমের ( ড্রয়িং রুম ) মত। দুই পাশে চামড়ার সোফা লাগানো। টেলিফোন আছে। মিনি বারও আছে। সেই বার থেকে ঠাণ্ডা বিয়ার বের করে এগিয়ে দিয়ে বলে, নে খা।

ওহ মাই গড ! এতো দেখি সিনেমার মত কাণ্ড একদম।

একটু পর ড্রাইভার সিটের পার্টিশন গ্লাসটা নেমে গেলো সড়সড় করে। ড্রাইভার মাথা বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে, বাসায় নাকি অন্য কোথাও যাবেন ওনাকে নিয়ে !

– বাসায় যাবো।

মাশুকের বাসায় এলাম জ্যামাইকায়। মাশুক একজন রুম মেইট নিয়ে থাকে। রুম মেইটের নাম শওকত। পরিচয় করিয়ে দিলো। কুঁচকুঁচে কালো মানুষটা দুই পাটি সাদা দাঁত বের করে বিশাল হাসি দিয়ে হ্যান্ডশেইক করলো। কথার টানে বুঝলাম বরিশালের মানুষ। পরে জানলাম ঝালকাঠি থেকে এসেছে সরাসরি আমেরিকায়। এর ভিতর শুধু আদমজী কোর্টে একবার ভিসার জন্য গিয়েছিল। মাশুক পরিচয় করিয়ে দিলো। শওকত হল বাসার হেড শেফ। সেই একমাত্র রান্না জানে। মাশুক পারে না।

একটু পর দেখি শওকত একটা প্লেটে অনেক গুলি পাউরুটি টোস্ট করে মাখন আর জেলি লাগিয়ে নিয়ে এলো। সাথে চারটা ডিম পোচ। কাগজের কন্টেইনারে ট্রপিকানা অরেঞ্জ জ্যুস। গ্লাসে ঢেলে দিলো। মুখে দিতে কলিজা জুড়িয়ে গেলো স্বাদে। গপাগপ খেতে শুরু করলাম। এদেশের সব খাবার দেখি অনেক মজা। প্লেইনের মত পচা না। সবগুলি ডিম পোচ খেয়ে ফেললাম হলের স্টাইলে ডিমে মুখ লাগিয়ে ফুড়ুৎ করে টান মেরে। আহারে, হলে কোন দিন একটার বেশী দুইটা ডিম খেতে পারি নাই পয়সার অভাবে। আচ্ছা এখন বেশী বেশী খেয়ে পুশিয়ে নেবো। সমস্যা নাই।

যাকে মাশুকের ড্রাইভার ভেবেছিলাম বাসের সমান গাড়িটার সে আসলে একজন আইনের ছাত্র। পার্টটাইম এই বড় গাড়ি মানে লিমুজিন চালিয়ে পড়ার খরচ যোগায়। একটু আড্ডা মেরে তার বড় গাড়িটা নিয়ে সে কাজে চলে গেলো।

আমি আর মাশুক সারাদিন আড্ডা মারলাম। বিকেলে হিলসাইড এভিনিউতে হাঁটতে বের হলাম। ওখানে তখন কোন বাঙ্গালী দোকান পাট ছিল না। দেশী মানুষও দেখা যায় না। সব কালাইয়া মানুষে ভরা। চোখা চোখই হলেই হাত পেতে একটা ডলার চায়। সিগারেট চায়। মাশুক আমাকে এদের সম্পর্কে সাবধান করলো।

হিলসাইডে দেখা হয়ে গেলো কামালের সাথে। জানলাম সে এসেছে দুইদিন আগে। একটু পর মুনিরের সাথে দেখা হয়ে গেলো। সে নাকি আমার আগের দিন এসেছে। সবাই মিলে মাশুকের বাসায় ফিরে এলাম। আড্ডা জমে উঠলো।

সেদিন ছিল সেপ্টেম্বরের তের তারিখ। হালকা শার্ট গায়ে ছিল। দিনে টের পাই নাই। সন্ধ্যা হতেই শীতে কাঁপুনি ধড়ে গেলো। সেপ্টেম্বরেই গরম থেকে হটাৎ শীত নামা শুরু করে দেয়।

আজ সেপ্টেম্বরের তের তারিখ। আমি এই দেশে এসেছি একই তারিখে। তবে উনত্রিশ বছর আগে। তখন একা ছিলাম। উড়নচণ্ডী ছিলাম। ভবঘুরে ছিলাম। যা ইচ্ছা করতে পারতাম কিছু না ভেবে। কত সুন্দর দিন কাটাতাম বন্ধুরা মিলে রাত ভর আড্ডা মেরে।

উনত্রিশ বছর পর এখন আমার অনেক লেজ হয়েছে। অনেক দায়িত্ব বেড়েছে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি বয়সে কিন্তু মনের খাতায় নয়। সেখানে এখনো আমি একদম আগের মত। তাইতো স্থান কাল ভুলে আমি আগের মতই আচরণ করি আমার জগতে।

বিয়ে করলে মানুষ প্রিয় বন্ধুদের হারিয়ে ফেলে। হরিহর আত্মারা তখন খুব ফর্মাল সম্পর্কের মানুষ হয়ে যায়। ওদের ভিতর আমিই সবার আগে বিয়ে করে ফেলেছি। আস্তে আস্তে দুরে সরে গেছে মাশুক। মুনির আমেরিকা ছেড়ে দেশে চলে গেছে। আমি প্রিয় সখা। অনেক স্মৃতির পাহাড় আছে ওর সাথে। কামাল চলে গেছে ক্যালিফোর্নিয়ায়।

যোগাযোগ হলেও আমরা আর আগের মত বিয়ারের কেইস নিয়ে বসি না। মুনির আর কমপ্লেইন করতে আসে না – শওকত বিয়ার গরম কেন ?
মাঝরাতে ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে না – গিলা কলিজা পাকাও নাই কেন ? যাও এক্ষণ কিনে এনে রান্না করো !

আহা, কি মধুর ছিল সেই দিনগুলি।

আমাদের রুম মেইট শওকতও বিয়ে থা করে আলাদা হয়ে গেছে। এক সময় এই শহর ছেড়ে ফ্লোরিডায় চলে গেছে। মাঝের অনেক অনেক বছর ওর সাথে কোণ যোগাযোগ ছিল না। গত মাসে ফ্লোরিডায় বেড়াতে গিয়ে শওকতকে খুঁজে পেলাম। ওর বাসায় গিয়ে দেখা করে এলাম। বয়স বেড়েছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শওকত অতীতের কিছুই ভুলে নাই। সরল মানুষটা আমাকে জড়িয়ে ধরে আগের মত জিজ্ঞেস করে – ওস্তাদ আছেন কেমন ? কেমনে পারলেন আমারে ভুইল্যা যাইতে ?

তারপরের প্রশ্ন _ ওস্তাদ, Munir ভাই কই ? কেমন আছে ? ওনারে দেখতে খুব মন চায়।

যে যেখানেই থাকুক , বিদেশ জীবন শুরুর সঙ্গীরা কেউ কাউকে ভুলে নাই। সবাই মনে মনে একে অপরকে খুঁজে বেড়ায়।

উনত্রিশ বছর পরেও আমরা সবাইবেঁচে আছি। আরেক উনত্রিশ বছর পর ডেফিনিটলি কেউ কেউ খরচের খাতায় চলে যাবো।

গেলে যাবো। ভেবে কি হবে ! যতক্ষণ শ্বাস, তখন আশ – এভাবেই কেটে যাক বাকি জীবন।

১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮