হুজ্জতি

– এই শোন না, একটা ভুল হয়ে গেছে। বাসায় ফেরার সময় দুধ আর কলা কিনে আনতে ভুলে গেছি একদম। গাড়িটা নিয়ে যাও না একটু। চৌরাস্তার দোকানটা টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স খোলা থাকে। প্লিজ,এনে দাও। তুমি তো দুধ কলা ছাড়া আর কিছু খাবা না সেহরিতে – বলে তিনি মানে গুণী স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তার মতি গতি বুঝার জন্য।

অসময়ে বউয়ের এমন কথা শুনে বিরক্ত লাগতে শুরু করলো মাহিনের।

সারাদিন কাজ করে রাত নটায় বাসায় ফিরেছে। এশা’র নামাজ পড়ে ডিনার খেয়েছে। অন্যদিন রুটি খেলেও আজ নিয়ম পাল্টে খাসীর মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছে। কাল প্রথম রোযা। সেহরিতে সে কিছু খেতে পারে না দুধ আর কলা ছাড়া। তাই রাতে ভাত খেয়ে নিয়েছে পেট ভরে। এরপর আর কারো কোন কথা শুনতে কিংবা বলতে রাজী না সে। টিভির সামনে বসেছে। দুই ঘণ্টা দেখবে পছন্দের কিছু। তারপর ঘুমিয়ে যাবে।

নতুন একটা একশন সিরিজ দেখা শুরু করেছে মাত্র। নাম ‘শুটার’। কাহিনী হল এক এক্স মেরিন স্নাইপার তার এক সহযোদ্ধার ষড়যন্ত্রে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে মারার চক্রান্তের জালে ফেঁসে গিয়ে প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে।

মাত্র দুইটা এপিসোড শেষ করেছে। টান টান উত্তেজনা। এর ভিতর যদি কেউ এসে কানের পাশে ভেজর ভেজর করে দুধ কলার গল্প শুনায়, কেমনটা লাগে !

বিরক্ত হলেও এড়ানোর উপায় নাই। জানে নিজের খাওয়ার জন্যই তাকে দুধ কলা কিনতে বাইরে যেতে হবে এই মাঝরাতে।

গজর গজর করতে করতে উঠে দাঁড়ালো টিভি পজ করে। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। সারাদিন ধরে একই অবস্থা ছিল। আগামী কয়েকদিন নাকি এমন থাকবে, আবহাওয়ার পুর্বাভাস জানিয়েছে। গায়ে একটা হুডি চড়িয়ে ওয়ালেট হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হল মাহিন।

বাসা থেকে এক কোয়ার্টার মাইল দুরের চৌরাস্তায় ডেলি দোকানটা। অন্য সময় হলে হেঁটেই যেতো। কিন্তু এতো রাতে বৃষ্টিতে হাঁটতে ইচ্ছা হল না। গুণীর গাড়িটা বাসার সামনে রাস্তায় পার্ক করা। ওটায় উঠে স্টার্ট দিয়ে রওনা দিলো। রেডিও বাজছে। গানের হৈ চৈ শুনে মনে হল যেন সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান ‘দুর্বার’ এ অনুরোধের গান বাজছে। বাসার গলি থেকে বের হয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে স্প্রিংফিল্ডে পড়লো সে। রাস্তাঘাট সব সুনসান নীরব। মানুষ দুরে থাক, একটা গাড়িও নাই রাস্তায়। বৃষ্টির পানিতে ভিজে ল্যাম্প পোস্টের আলোয় রাস্তা চক চক করছে। আনমনে সেদিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছিলো। আচমকা গাড়ির খক খক করে কাশির মত আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরল মাহিনের। এক দেড়শ গজ মাত্র এগিয়েছে। কাশি দিতে দিতে গাড়ির ইঞ্জিন থেমে গেলো।

আরে এটা আবার কি !

গ্যাসের কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখে একদম শূন্যের কোটায় গিয়ে লাল বাটি জ্বলছে। কেমন লাগে এখন ! এই মেয়েটা শুধু গাড়ি চালায়। গাড়ির কোনদিকে খেয়াল রাখে না। গ্যাস সব সময় মাহিনই ফিল আপ করে। এই সপ্তাহে কেমন করে সে সেটা করতে ভুলে গেছে। ব্যস, এবার ঠেলা সামলাও ভুলের। কয়েকবার ইগ্নিশন ঘুরিয়ে ওঁয়াও ওঁয়াও কান্না ছাড়া ইঞ্জিনের খিলখিল আওয়াজের হাসি শুনতে পেলো না বেচারা। গিয়ার নিউট্রালে দিয়ে কোনমতে গাড়িটা ঠেলে রাস্তার পাশে নিয়ে দাঁড় করালো।

দোকানটা খুব দুরে না। গাড়ি লক করে পকেটে শুধু একটা বিশ ডলারের নোট নিয়ে সে রেডি হল। ছাতা ধরতে ভাল্লাগে না। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। অল্প একটু দূরত্ব। হুডটা মাথার উপর টেনে দিয়ে হাঁটা ধরলো। লম্বা লম্বা কদম ফেলে চৌরাস্তায় এসে দেখে দোকানটা বন্ধ। বন্ধ আসোলে অনেকদিন ধরে। আগুন লেগেছিল বলে বন্ধ হওয়ার পর আর খোলে নাই। এখানে আসা হয় না কিছু কিনতে, তাই মনে ছিল না। মেজাজটা খিচড়ে গেলো। আর কোন দোকান নাই।

রাস্তার উল্টা পাশে গ্যাস স্টেশন আছে। ফাঁকা রাস্তার উপর দিয়ে হেঁটে সেখানে গেলো মাহিন। গেইট বন্ধ। বুলেট প্রুফ উইন্ডোর ওপারে একটা ইন্ডিয়ান ছেলে বসা। মিল্ক আছে কিনা জিজ্ঞেস করলো মাহিন।

মাথা নেড়ে ‘না’ বলে দিয়ে নিজের মোবাইলের দিকে তাকানোর কাজে ফিরে গেলো সে। এবার সে জিজ্ঞেস করলো তার কাছে কোন কন্টেইনার আছে কিনা। সে একটু গ্যাস কিনে তার গাড়ীতে ভরবে। বিরক্ত হয়ে আবার তাকালো কাঁচের ওপাশ থেকে ছেলেটা। মাহিনের দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে বলল – নেহি হ্যায় মেরি পাছ।

বেটা নিশ্চয়ই নতুন এসেছে। কাগজপত্র নাই। ইংরেজী পারে না। তাই গ্রেইভইয়ার্ড শিফটে কাজ করছে। তাই মেজাজ খারাপ তার। হেল্প করতে চাইছে না।

কিছু করার নাই বিরক্ত লাগলে। ইচ্ছা করলো দুধ কেনার আশা ছেড়ে দিয়ে বাসায় ফিরে যেতে। বাসা এখান থেকে বেশী দুরে না। আবার মনে হল দুধ না হলে সে সেহরিতে কি খাবে ! প্রথম রোজা বলে কথা। এতো অলস হলে কি চলে নাকি ! সে ছাড়া বাসার বাকিরাও দুধ খায়। না হলে খারাপ দেখায়। যদিও দোষটা তার না। কিন্তু এখন সেই হিসাব করে লাভ নাই।

হটাৎ মাথায় এলো, আড়াই তিন মাইল দুরে ‘ফেয়ারওয়ে সুপার মার্কেট’ আছে। ওটা টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স খোলা থাকে, সে জানে। ইহুদীদের মার্কেট। সবকিছু পাওয়া যায়। জিনিসও খুব ভাল জাতের। ভালই হবে। ফ্রেশ দুধ, কলা পাওয়া যাবে। তাছাড়া মনে হয় গুণী বলেছিল, বাসায় পুদিনা পাতা নাই। এই পাতা ছাড়া পেঁয়াজু মজা হয় না। ওখানে পাওয়া যাবে। দুই আড়াই মাইল তো মাহিন ডেইলী পার্কে হাঁটে। কোন ব্যাপার না। যাই নিয়ে আসি গিয়ে – ভেবে সেদিকে হাঁটতে শুরু করলো।

ইউনিয়ন টার্নপাইক ধরে হাঁটতে লাগলো সে দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে। পায়ের লোফার জোড়া মোজা ছাড়া পরেছে। তাই পায়ে একটু শীত লাগছে। উপরে হুডি পরা থাকলেও নীচে প্যান্ট না, স্লিপিং ট্রাউজার পরা। পাতলা পায়জামা ভেদ করে নিম্নাঙ্গে ঠাণ্ডা লাগছে। এতো ভেবে লাভ কি, এইতো অল্প একটু রাস্তা মাত্র। ইউনিয়ন টার্নপাইক থেকে উইনচেষ্টার বুলেভার্ডে ঢুকল বাঁয়ে মোড় নিয়ে। ইয়া আল্লাহ, এই রাস্তা দেখি গোরস্থানের মত নীরব একদম। দিনের বেলায়ও এমন থাকে। তার উপর এই রাস্তায় একটা মানসিক রোগীদের হাসপাতাল আছে। সেই হাসপাতালের গেইটে টিম টিম করে একটা বাতি জ্বলছে। এছাড়া রাস্তায় অনেক বাতি নাই। ভাল অন্ধকার। এতক্ষণে একটা গাড়িও যেতে দেখলো না মাহিন।

জোরে পা চালালো সে। রাতের অন্ধকারে দুই পাশে রাস্তা আগলে রাখা বিশাল সব গাছের সারি নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি পড়ে টুপটাপ আওয়াজ হচ্ছে সেগুলির ডালপালা থেকে। এমন দৃশ্য দেখে মাহিনের মনে এলো ছোটবেলার প্রিয় নায়ক কুয়াশার কথা। কিশোর থ্রিলারের কুয়াশা এমন ভেজা রাতে একাকী রাস্তায় বের হত কোন রহস্য উন্মোচনে। তার পরনে থাকতো লম্বা ওভারকোট, মাথায় কাউবয় হ্যাট। মাহিনের মনে হল, অমন পোশাক পরে থাকলে তাকেও আজ কুয়াশা’র মত মনে হতো। ইস,তার তো অমন কোট আর হ্যাট সবই আছে। আজ পরলেই হতো। কিন্তু কে জানতো যে তাঁকে আজ রাতে কুয়াশা’র মত অন্ধকার রাস্তায় একা হাঁটতে হবে !

গাছপালার সারি পার হয়ে কিছু ঘর বাড়ির দেখা মিললো। সব অন্ধকার নীরব পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। কেউ যেন থাকে না ওসব বাড়িগুলিতে। রাত গভীর হলে এমনই মনে হয়। এদেশের মানুষ তো আর উইকডেইজের রাতে খামোকা জেগে কাটায় না। মাহিন নিজেও আর রাত জাগতে পছন্দ করে না।

এতো নীরবতায় একা হাঁটতে গিয়ে তার গান শুনতে ইচ্ছা হল। পকেটে হাত ঢোকালো মোবাইল বের করতে। ওটা পকেটে নাই। ওহ মাই গড ! গাড়ীতে ফেলে এসেছে। পাতলা স্লিপিং ট্রাউজারের পকেটে ঢাউস ফোনটা রেখে আরাম লগে না হাঁটতে। তাই ড্রাইভিং সিটের পাশে রেখেছিল। গাড়ি আচমকা ওভাবে থেমে যাওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে গেছে।

হাতে ঘড়ি নাই। কতক্ষণ ধরে সে বাইরে বাইরে, আন্দাজ করতে চেষ্টা করলো। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ মিনিট তো হবেই। মোড়ের দোকান থেকে দুধ নিয়ে ফিরে যেতে দশ মিনিটের বেশী লাগার কথা না। গুণী নিশ্চয় তার খোঁজে এতক্ষণে অনেকবার ফোন করে না পেয়ে অবাক হচ্ছে।

আচ্ছা, সে ওকে মোবাইলে না পেয়ে সে কি ভাববে ! হয়তো ভাববে এক্সিডেন্ট করেছে। নয়তো ভাবছে রাস্তার হোমলেস এর পাল্লায় পড়ে মারামারি করছে। মনে হয়ে হাসি পেলো। আচ্ছা দেখা যাক না, স্বামীর জন্য কত টান তার।

আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে সে ডগলাস্টন এভিনিউতে ঢুকে পড়লো। আর কিছুদুর পরেই সুপার মার্কেটটা। ওটায় গিয়ে কেনাকাটা করে ওদের দিয়ে না হয় একটা ট্যাক্সি ডাকিয়ে নিয়ে বাসায় চলে যাবে। সমস্যা নাই। ভেবে জোরে পা চালালো।

জোরে হাঁটতে গিয়ে একটা পট হোলে উস্টা খেয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো মাহিন। কোনমতে তাল সামলে নিয়ে ভাতে মরা মেয়রের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতে শুরু করলো খিস্তি করে – ‘শালার বেটা কোন কামের না। যেমন ছিল ভাতে মরা ওবামা, ঠিক তেমনি এই মেয়র বেটা। শুধু সুন্দর সুন্দর শুকনা ডায়ালগ দেয়। অথচ এতো টাকা ট্যাক্স নিয়েও শহর পরিচ্ছন্ন করে না বেটা।’

বেটার উদ্দেশ্যে একটা সিলেটী আঞ্চলিক গালি দিলো – ‘বেডা আবাদির গরর আবাদি একটা। কুনো কামের না’ – দিয়ে নিজেই হেসে দিলো।

তার হাসি একটু পরেই ম্লান হতে শুরু করলো। দুর থেকে সুপার মার্কেটের সাইনবোর্ডের বাতি দেখতে পেলো। আরও কাছে যেতে পারকিং লট ফাঁকা দেখে সন্দেহ হল – বন্ধ নাকি !

আজব তো। এটা তো চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকার কথা। এইতো গেলো বছর কামাল বেড়াতে এলে তার বউয়ের বার্থডে উপলক্ষে অনেক রাতে সে কামালকে নিয়ে এখান থেকে কেইক আর ফুল কিনে নিয়ে গিয়েছিলো। তাইলে আজ বন্ধ মনে হচ্ছে কেন ?

আরো কাছে গিয়ে দেখে সত্যি মার্কেটটা বন্ধ। হয়তো ইহুদীদের কোন হলিডে আছে সেজন্য। আর না হয় ওদের নিয়ম বদলেছে। সে না হয় হল। কিন্তু তার কি উপায় হবে এখন ! দুধ পেলো না। কলা পেলো না। সাথে গাড়ি নাই। ফোন নাই। এখন উল্টা পথে এতদূর হেঁটে সে বাসায় ফিরবে কেমন করে !

রাস্তায় একটা মানুষ নাই। একটা গাড়িও যেতে দেখছে না যে হাত তুলে থামিয়ে নিজের করুন অবস্থার কথা জানাবে।

আচ্ছা, হাত তুললে কি কেউ থামবে ?

সে নিজে হলে কি এমন গভীর রাতে নির্জন রাস্তায় কারো হাত তোলা দেখলে থামত সাহায্য করার জন্য ?

একদম না। তারমানে কেউ দাঁড়াবে না। ফিরতি পথে হাঁটা ধরলো।

একটা বাড়ির দোতলায় লাইট জ্বলে উঠলো। হয়তো কেউ জেগে আছে। নয়তো তার মত মাঝরাতে হিসু করতে উঠেছে। যাবে নাকি ঐ বাড়িটায়। বেল টিপে তার অবস্থার কথা জানিয়ে শুধু অনুরোধ করবে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে ! কাজটা কি ঠিক হবে ? যদি উল্টা ব্যাপার ঘটে ! এতো রাতে বাইরে অচেনা আগন্তক দেখে ভয় পেয়ে যদি কুকুর ছেড়ে দেয় ? কিংবা গুলি করে বসে ! তাইলে তো খামোকা জানটাই হারাবে ।

নাহ, কাউকে নক করা ঠিক হবে না।

উল্টা পথে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলো। নিজেকে সাহস যোগাতে চাইলো মনে মনে – কিরে বেটা, এতো বড়াই করিস সবার কাছে চার পাঁচ মাইল হাঁটা তোর কাছে কোন ব্যাপার না। তাইলে বাপ, এখন ভয় না পেয়ে সেই কথা কাজে লাগা। জান বাঁচানোর জন্য হাঁট। হেঁটে বাড়ি পৌঁছা তাড়াতাড়ি। নইলে তোর বউ মূর্ছা যাবে তুই মরেছিস ভেবে। আর না হয় পুলিশ ডেকে তোকে খুঁজতে পাঠাবে তোর ছবি হাতে ধরিয়ে দিয়ে।

হেঁটে আবার উইনচেষ্টার এভিনিউতে পড়লো। সেই ফাঁকা রাস্তা। মানসিক হাসপাতাল। লাইন ধরে গারবেজ নেয়ার বিশাল ট্রাকগুলি দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলি থেকে দুগন্ধ বের হচ্ছে। গাছের সারি থেকে সোঁ সোঁ করে বাতাসের আওয়াজ ভীতিকর লাগছে।

পা যেন আর চলছে না। অনেক হেঁটে গলা শুকিয়ে গেছে। ঘেমে গায়ের হুডিটা ভিজে গেছে। তার উপর বিরক্তিকর প্যাঁচপ্যাঁচে বৃষ্টি যেন মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। রাস্তার জমানো পানি জুতার ভিতর ঢুকে পচপচ আওয়াজ তুলছে। আর ভাল্লাগছে না।

আজগুবি ভাবনা মাথায় ভর করতে শুরু করলো। তার মনে পড়লো ‘মাসুদ রানা’র সেই পাগল বৈজ্ঞানিক কবীর চৌধুরীর কথা। আচ্ছা এখন যদি সেই কবীর চৌধুরী এসে এই মানসিক হাসপাতালের সব বদ্ধ উন্মাদগুলিকে রাস্তায় ছেড়ে দেয়, কি অবস্থা হবে ! তাদের কেউ যদি তাকে পায়, তাইলে সে কি করে জান বাঁচাবে ! কল্পনায় তো নিজেকে ব্রুস লি হয়ে যায়। কুংফু কারাতে মেরে একে ওকে সাইজ করে দেয়। বাস্তবে সে কিছুই পারে না।

অমন ভেবে সত্যি ভয় ভর করতে শুরু করলো। এবার এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছে জোরে। আহ জুতা জোড়া বড্ড জ্বালাচ্ছে। পানি ঢুকে ভারি হয়ে পা থেকে খুলে পড়তে চাইছে। একবার থামল জুতার পানি ফেলতে।

পানি ফেলে চোখ উঠাতে গিয়ে মনে হল কি জানি একটা সাঁৎ করে সরে গেলো। গা চমকে উঠলো।

পর মুহূর্তে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে ভাবলো – ধুর, সত্যি কি আর কবীর চৌধুরী নামের কোন পাগল আছে নাকি যে এখানে এসে পাগল ছাড়তে যাবে ! ওসব শুধু থ্রিলারেই হয়।

নাহ, ভুল না। আবারও কিছু নড়ে উঠলো গারবেজ ট্রাকের আড়ালে। এবার পরিষ্কার খসখস আওয়াজ শুনতে পেলো।

আরে খোদা, একি হচ্ছে !

মাহিন দাঁড়িয়ে গেল। সিউর হতে চাইলো আসল ঘটনা কি । ডানে বামে যাওয়ার জায়গা নাই। গাছ আর তারপর নিচু ডিচ। তারপর অনেক ঢালুতে হাইওয়ে। মাহিনের মনে পড়লো গত সপ্তাহে লিপু আর মাসুম তাদেরকে থাই ফুড খাইয়ে বৃষ্টি ভেজা রাতে ফ্রান্সিস লুইস বুলেভার্ডের নীরব রাস্তা দিয়ে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছিল্লো। হটাৎ লিপু জিজ্ঞেস করলো – আচ্ছা ভাইজান, আপ্নে এই অন্ধকারে পাশের বনের ভিতর একা যেতে পারবেন ?

আমি আমতা আমতা করে বলেছিলাম – যাওয়া ঠিক হবে না। রাতে ওখানে অনেক রেক্কুন বের হয়। ওরা কিন্তু এমনে হিংস্র না হলেও কাউকে রাতে একা পেলে ঠিক আক্রমণ করবে খাবার ভেবে।

যদিও মাসুম বীরদর্পে বলে ছিল সে নাকি একা বনে ঢুকতে পারবে। মাহিন হেসেছিল নীরবে।

আজ মাহিন সেই অবস্থায় পড়েছে। একা। নীরব বন জঙ্গলে ঘেরা রাস্তায় ভয়ে ভয়ে হাঁটছে জান হাতে নিয়ে। এবার সে পরিষ্কার দেখতে পেলো। না কোন মানুষ না। চারপেয়ে কোন জন্তু। ওহ মাই গড। এতো রাতে রাস্তায় কারো কুকুর ছাড়া থাকার কথা না। এগুলি নিশ্চয়ই বন্য কোন প্রাণী। পাশে এলিপন্ড পার্কের বিশাল ঘন জঙ্গল। সেখান থেকে বের হয়েছে।

কি ওগুলি ! বাঘ না। তবে শেয়াল জাতীয় কিছু হবে। তারমানে খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছে। বেশ কয়েকটা দেখল। গারবেজ ট্রাকের ভেতর লাফিয়ে ঢুকছে। বের হচ্ছে। ময়লার গন্ধে ভেবেছে কোন খাবার আছে ওখানে। এরপর যদি সামনে মানুষের মত জ্যান্ত খাবার দেখতে পায়, তাইলে আজ ওদের ভুরি ভোজ হবে – এমন ভেবে মাহিনের শরীরে কাঁপুনি শুরু হল।

পেছন ফিরে দৌড় দিবে নাকি ! কিন্তু তাইলে তো ওদেরকে উস্কানি দেয়া হবে আক্রমণ করার জন্য। সামনে ওরা। পেছনে দৌড়াতে ভয় লাগছে। পাশে লুকানোর কিছু নাই।

এখন কি উপায় হবে ?

কিচ্ছু করার নাই। তার মরণ এভাবে লিখে রেখেছে আল্লাহ। সে কেমনে বদলাবে ? তাই বলে শেয়াল কুকুরের খাবার হয়ে ? ছি ছি । বাঘে খেলেও ইজ্জতটা থাকতো।

আচ্ছা, আল্লাহ তো আছে তাই না ! সেদিন রহমত বলছিলো আল্লাহর নাকি আকারও আছে। সাত আসমানের উপর তার আরস যেহেতু আছে সবাই বলে,তাইলে সেই আরসে বসার জন্য তো কারো আকার লাগবে। তো সেই আকারধারী আল্লাহর সন্ধানে উপরে তাকালো মাহিন।

কল্পনা করলো সে আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছে।

তারপর বলতে শুরু করলো – ‘হে আল্লাহ, আমি তেমন কোন ভাল মানুষ না । তবে খারাপও না। চুরি ডাকাতি করি নাই কোনদিন। কারোটা খাই নাই। একটা বদমেজাজী। তবে অন্যায়ভাবে কারো উপর খেপি না। তবুও আমার অনেক বদনাম তোমার বান্দাদের কাছে। কারণ আমি খুব বেশী স্পষ্ট কথা বলি। জোড়াতালি মারি না। তাইলে তোমার মন চাইলে তুমি এখন আমাকে এসব শেয়াল কুকুরের ভোজ হওয়া থেকে রক্ষা করো। মারতে চাইলে বাঘ সিংহ পাঠায়ে মারো। আপত্তি নাই। প্লিজ, আই মিন ইট। আরেকটা কথা। আমি কিন্তু কোন অকামে এতো রাইতে বাইর হই নাই। বউ পোলাপান দুধ কলা খাইয়া তোমারে খুশী করতে রোযা রাখবে। সেগুলি কিনতে বাইর হইসি। সবই তোমার জন্য। সো ইটস ইউর জব টু সেইভ মি নাও। অর এলস আই উইল স্টপ বিলিভিং ইন ইউর একজিস্ট্যান্স।’

সামনে তাকিয়ে দেখে একটা না দুইটা না- অনেকগুলি শেয়াল জাতীয় রেক্কুন দল বেঁধে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। আক্রমণের পূর্ব প্রস্তুতি তাদের। এমন সময় মাহিন গাড়ির আওয়াজ শুনলো। পেছনে তাকিয়ে হেডলাইটের আলো দেখলো। সামনে থেকেও আরেকটা গাড়ীর হেডলাইট দেখলো। দুটো গাড়ী এসে তার পাশে থামল। মাহিনের ধড়ে পানি ফিরে এলো পুলিশের গাড়ী দেখে। দুই গাড়ি থেকে চারজন অফিসার বের হয়ে এলো কোমরের পিস্তলে হাত রেখে।

তার উপর টর্চ লাইটের আলো ফেলে জিজ্ঞেস করলো – এতো রাতে সে এখানে একা কি করছে !

মাহিন শুধু বলল – মাই নেইম ইজ মাহিন রায়ান। আই কেইম আউট টু বায় মিল্ক এন্ড বানানা ফ্রম সুপারমার্কেট। মাই কার র‍্যান আউট অফ গ্যাস এন্ড স্টপড। অফিসার প্লিজ টেইক মি ইনসাইড ইউর স্কোয়াড কার ফার্স্ট। আই এম ফিলিং ভেরী কোল্ড এন্ড স্কেয়ারড। লেট মি গেট ইন ফার্স্ট দেন ইউ আসক মি এনিথিং ইউ ওয়ান্ট।

পুলিশ তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে আইডি চাইলো। মাহিন জানালো তার ওয়ালেট গাড়ির ভিতর। গাড়ি স্প্রিংফিল্ড বুলেভার্ডে পড়ে আছে।

পুলিশ বুঝলো মাহিনই সেই ব্যাক্তি যাকে তারা খুঁজতে বেরিয়েছে তার বউয়ের ফোন পেয়ে।

হ্যাঁ, এক ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও সে বাসায় না ফেরাতে গুণী নাইন ওয়ান ওয়ানে ফোন করে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে গেলো। জানালো সব। পুলিশ এলে তাদেরকে মাহিনের ছবি দিলো। পরনের কাপড়ের বর্ণনা দিলো। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে গ্যাস স্টেশনের ইন্ডিয়ান পোলার কাছে মাহিনের প্রথমে দুধ পরে গ্যাস কিনতে চাওয়ার কথা জেনেছে। তারপর খুঁজতে বেরিয়েছে। ভাগ্যিস, রেক্কুন আক্রমণ করার আগেই তারা ওখানে হাজির হয়েছিলো।

গাড়ির কাছে পৌঁছে পুলিশকে নিজের আইডি দেখাল মাহিন। তারপর পুলিশই তাঁকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিলো।

বাসায় সেদিন আর দুধ কলা এলো না। আহারে ! সাধের দুধ কলা।

১৭ই মে, ২০১৮