ক্যাম্পাসের স্মৃতি

 

সেদিন ছিল মাষ্টার্সএর শেষ দিনের ক্লাস। শেষ দিনের শেষ ক্লাসটা ছিল কুদ্দুস স্যারের।
এই ক্লাসটা শেষ হলে আর কোন ক্লাস করতে হবে না। বাকী থাকবে ফাইনাল পরীক্ষা এবং ভাইবা। অনেক স্বাদের ইউনিভার্সিটি জীবনের ইতি হয়ে যাবে। 
অতঃপর বাক্স পেটরা গুছিয়ে হল ছাড়তে হবে। স্বাধীন, বোহেমিয়ান লাইফ ছেড়ে চাকরি খুঁজতে হবে । ক্লাসে বসে আনমনে এসব ভাবছিলাম।
আমার মনযোগ নাই দেখে স্যার আমার দিকে ফিরে বললেন - হাই সাব কি জাগি জাগি স্বপ্ন দেইকতাসেন নি কোনো ? স্যারের কথায় আমি বাস্তবে ফিরে এলাম।

কুদ্দুস স্যার আমাদের ডিপার্টমেন্টের ছাত্রদের কাছে অনেক জনপ্রিয় টিচার। সব সময় ছাত্রদের সাথে হাসি খুশী থাকেন। হাসি ঠাট্টা, হই চই করেন। লেকচারের ফাঁকে ফাঁকে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে মজার গল্প বলেন। মোদ্দা কথা হল,আমরা কখনোই স্যারের ক্লাস ফাঁকি দিতাম না।


স্যারের দেশের বাড়ি নোয়াখালীতে। তিনি সব সময় ক্লাসে খুব সাবলীলভাবে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। আমার গ্রামের বাড়িও নোয়াখালী জেলায়। স্যার এটা জানতে পেরে আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার বাপ দাদার চৌদ্দ গুষ্ঠির সব খবর জেনে নিয়েছেন। ক্লাসে এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন - হাই সাবের হুত ( ছেলে) ছোড হাইসাব, কেমন আছেন?



স্যারের ডাকে কল্পনার জগত থেকে ক্লাসে ফিরে এলাম। স্যার আসোলে কিছু পড়াচ্ছিলেন না। শেষ ক্লাস তাই তিনি নিজেও মনে হল একটু আবেগপ্রবন এবং নষ্টালজিক হয়ে পড়েছেন। খুব ভাল মুডে কথা বলছেন। কখনো অনেক আবেগ নিয়ে কখনো চটুল কোন বিষয় নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছেন।


তিনি বলছিলেন, আপনারা ইউনিভার্সিটি ছেড়ে যাবার পর কেউ কেউ চাকুরি করবেন, কেউ ব্যবসা করবেন। কেউ চাকুরির আগেই বিয়ে করে ফেলবেন। বিশেষ করে যারা প্রেম করেন তারা তো পারলে এখুনি বিয়ে করে ফেলেন। লাইব্রেরীর কোনায়, ব্রিটিশ কাউন্সিলের পিছনে আপনারা জোড়া বেঁধে বসে থাকতেন।আমি অনেক দিন দেখেছি। দেখে ভাল লাগত।

এই কথা বলায় আমি ঘাঁড় ঘুরিয়ে পিছনের বেঞ্চে বসা এক প্রেমিক বন্ধুর দিকে মাত্র তাকিয়ে চোখ টিপেছি,অমনি স্যার আমাকে ডেকে বসল।

বলে - হাইসাব, আন্নে খাড়ান।

আমি উঠে দাঁড়ালাম।

তারপর বলে - আন্নের কি খবর,প্রেমট্রেম কইচ্ছেন নি ? স্যারের কোথা শুনে ক্লাসে হাসাহাসি আরম্ভ হয়ে গেছে।

আমি জবাব দিলাম - না স্যার, আমার কোন গতি হয় নাই।

তখন স্যার বলে - আন্নে এইটা কি কইলেন। এইজ্ঞা প্রেম কইত্তে হারেন ন। হেলে (তাইলে) এক কাম করেন। আন্নে বেঞ্চের উফরে উডি 
খাড়ান।

প্রথমে ভেবেছি আমি হয়ত ভুল শুনেছি। তাই ঠায় দাঁড়িয়ে আছি দেখে স্যার আবার বলল আমাকে বেঞ্চের উপরে উঠে দাঁড়াতে। এবার আমিসত্যি বোকা হয়ে গেলাম। ওদিকে পুরো ক্লাস অ্ট্রহাসিতে ফেটে পড়েছে মজার চোটে।বন্ধুরা সবাই এক যোগে স্যারের পক্ষ নিয়ে আমাকে বেঞ্চেরউপর উঠে দাঁড়াতে বলছে। সেই মূহুর্তে সব বন্ধুদেরকে আমার বিষের মত লাগছিল।



সত্যি কথা বলতে কি, প্রাইমারী স্কুল থেকে শুরু করে আমি কোন দিন বেঞ্চের উপর উঠে দাঁড়ানোর শাস্তি পাই নাই। আর আজ কিনা মাষ্টার্স এর শেষ ক্লাসে আমাকে বেঞ্চের উপর উঠতে হচ্ছে। হাসব না কাঁদবো বুঝছিলাম না। কিন্তু স্যারের কথা তো আর ফেলা যায় না। অগত্যা আমি আমার ছয় ফুটের উপর লম্বা দেহ নিয়ে পুরো ক্লাসের সামনে ক্লাউন সেজে বেঞ্চের উপর উঠে দাঁড়ালাম। স্যার সহ ক্লাসের সব ছেলে মেয়েরা হেসে গড়া ড়ি খাচ্ছিল আমার দুরবস্থা দেখে।আমি আর কি করব। আমিও ওদের দেখা দেখি বোকার মত হাসা আরম্ভ করলাম।

ঠিক সেই মুহুর্তে ক্লাসের সামনের বারান্দা দিয়ে জালাময়ী শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল আসছিল। কোন দলের মিছিল সেটা বড় কথা নয়।সেইসময় আমরা সবাই সবাইকে চিনতাম। সেইম ব্যাচের অন্য ডিপার্টমেন্টের ছেলে মেয়েদের সাথেও তুই তোকারি সম্পর্ক ছিল।

মিছিল যখন ঠিক আমাদের ক্লাস রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল,আমাকে বেঞ্চের উপর দাঁড়ানো দেখে ওরা শ্লোগান থামিয়ে আচমকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়ে কিছুক্ষন অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আমার ক্লাসের অন্য সবার সাথে তাল মিলিয়ে মিছিলের 
সবাই একসাথে হাসা আরম্ভ করে দিল।

বারান্দায় মিছিলের মানুষ দেখে স্যার একটু ভড়কে গিয়ে আমাকে বলে -ওরে বাবুরে, আন্নের দলের হোলাহাইন ছলি আইসে লাডিসোডা লই। আন্নে তাড়া তাড়ি করি নামি যান।

এই কথা শুনে মিছিলের ছেলেরা স্যারকে বলে - না স্যার,আমরা চলে যাচ্ছি।মুরাদ বেঞ্চের উপরেই থাক।

কিন্তু স্যার আমাকে নেমে যেতে বললেন।

সেই কত আগের কথা। কিন্তু আজো স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে। কুদ্দুস স্যার শুধু টিচার ছিলেন নাা। তিনি ছিলেন আমাদের সেভিয়র। ভাইবা বোর্ডে এক্সটার্নাল যেন আমাকে প্রশ্ন করে আটকাতে না পারে, সেদিকে খুব খেয়াল রেখেছিলেন। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির সাথে বাস্কেটবল টুর্নামেন্টে মারামারি লেগে গেলে স্যার বীর দর্পে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন। এই হল আমাদের প্রিয় কুদ্দুস স্যার।

মুরাদ হাই, নিউইয়র্ক।

২১শে আগষ্ট,২০১৫