মায়ের চকলেট

আজ আকাশের মুখ কালো নয়। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক। ডিসেম্বর মাসে এমন দৃশ্য বিরল। চোখ খুলে বাইরে তাকিয়ে এমন আলো দেখলে মন ভাল না হয়ে উপায় নাই। একটা সুন্দর কথা শুনে মন আরো ভাল হয়ে গেল।

শুয়ে শুয়ে ফেইসবুকে চ্যাট করছিলাম দেশের এক বন্ধুর সাথে।

জিজ্ঞেস করলাম – কি কর ?

বলে – ছেলে মেয়েদের নিয়ে গ্রামে এসেছি মায়ের সাথে দেখা করতে।

শুনে খুব ভাল লাগল। আজকাল মানুষের ব্যস্ত জীবনে কয়জন গ্রামে যায় মায়ের সাথে দেখা করতে ! তাও আবার সাথে ছেলে মেয়ে নিয়ে। খুব বিরল ব্যাপার। আমার এই বন্ধু সুযোগ পেলে ঢাকা থেকে যশোরে চলে যায় মায়ের কাছে। ইচ্ছা করলে মা’কে ঢাকায় নিজের কাছে এনে রাখতে পারে। কিন্তু সে বুঝেছে মায়েরা নিজের সংসারের কতৃত্ব ছেড়ে কখনো ছেলে মেয়ের সংসারের বোঝা হয়ে থাকতে আরাম পায় না। তাই সে নিজেই চলে যায় গ্রামে মায়ের কাছে।

আমি জানতে চাই তাঁর মা কেমন আছেন। তার উত্তরে সে বলে – ঢাকা থেকে মায়ের জন্য চকলেট নিয়ে এসেছিলাম। মা সেই প্যাকেট কোলে নিয়ে বসে আছে। আনন্দে দুই চোখ চক চক করছে। নাতী নাতনীরা চকলেটের ভাগ চাচ্ছে। কিন্তু তিনি কাউকে ভাগ দিবেন না এমন কপট ভাব করে প্যাকেট আঁকড়ে ধরে বসে আছে বিছানায়। এই কথাগুলি শুনে আমার বুকের ভিতর কেমন এক অদ্ভুত আনন্দের ঝিলিক অনুভব করলাম দৃশ্যটা কল্পনা করে আমি হো হো করে হেসে দিলাম। খুব ভাল লেগেছে ।

মায়ের জন্য মানুষ শাড়ি কেনে। ঔষধ কেনে। ফল কেনে। চকলেট কিনতে কখনো শুনি নাই। বুড়ো মানুষরা আবার এসব খায় নাকি! এসব তো বাচ্চাদের খাবার। মানুষের বয়স হলে কি সব স্বাদ আহলাদ শেষ হয়ে যায় ? আমার কিন্তু সেটা মনে হয় না। আমি যদি নিজের কথা বলি, পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। মাথার চুল সব ঝরে পড়ে গেছে। গায়ে গতরে বড়, জোয়ান দুইটা ছেলে আছে। তাহলে আমিতো অফিসিয়ালী বুড়া মানুষ। ভেরি অনেষ্টলি বলি, আমি নিজেকে কখনো তেমন ভাবি না। আঠারো বছর বয়সে যা করতাম আমি এখনো তাই করি সব সময়। আমার যখন যা করতে মন চায় আমি ঠিক তাই করে ফেলি। কে কি মনে করল আমি এসব নিয়ে খুব মাথা ঘামাই না। জীবন আমার, তাই আমি সেটা আমার মত উপভোগ করি। কাউকে জমা খরচ দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা কিংবা পরিকল্পনা নাই আমার। আমি এখনো সুযোগ পেলে নিজের জন্য জামা কাপড় কিনি নিজের পছন্দে। ছেলেদের চাইতেইবেশী নাক উঁচা পোষাকের ব্যাপারে। বরং ওদের কাপড়ও আমি কিনি আমার পছন্দে। যদিও ওরা নিজে পছন্দ করে কেনার বয়স হয়ে গেছে অনেক আগেই। বয়স হলে বুড়ো মানুষের মত ভাব ধরতে হবে এমন কোন কথা কোথাও লেখা আছে নাকি ? সন্তান যদি জানে মা চকলেট খেতে ভালবাসে তাহলে তাকে সেটা কিনে দেয়া উচিত। কে কি মনে করবে সেটা ভাবার দরকার নাই।

সন্তান যখন বড় হয়ে নিজে সংসারী হয়, মা বাবা হয় তাদের মা তখন অফিসিয়ালি বয়ষ্কা বৃদ্ধা হিসাবে গন্য হয়ে যায় সংসারে। মায়ের কাজ তখন শুধু নামাজ পড়া, তসবি পড়া, নাতিদের সাথে গল্প করা, অষুধ খাওয়া এবং নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া। এর চাইতে বেশি কিছু হলে, ছেলে সন্তান মা’কে নিজে হজ্ব পালন করে আসে। এরপর যেন মায়ের আর কিছু করার নাই। নিজের যা কিছু সঞ্চয় আছে সন্তানদের ভাগ করে দিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। সম্ভব হলে যত তাড়াতাড়ি মরে গিয়ে সন্তানের কাঁধের বোঝা কমিয়ে দেয়া।

আমার কপাল পোড়া, বুদ্ধি হবার আগে মা মরে গেছেন। সত্যিকার অর্থে মায়ের স্বাদ কি সেটা পুরোপুরি পাই নাই। তাই মনে হয় আমার ভিতর এই হা হুতাশ একটু বেশী। অন্যের মা দেখলে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে দেখি। বুঝতে চেষ্টা করি মা ছেলের সম্পর্ক কেমন। খেয়াল করে দেখেছি, বয়স হলে মায়েরা যেন বাসার পুরনো সেগুন কাঠের ফার্নিচারের মত হয়ে যায়। ইচ্ছা করে না খুব কাছে টানতে কিনতু সেগুন কাঠ বলে কথা। তাই ধরে রাখতে হয়। সবাই যে এমন সেটাও ঠিক নয় । অনেক ছেলেরা চাইলেও নিজের স্ত্রীর ভয়ে মায়ের প্রতি ভালবাসা দেখাতে পারে না। অজুহাত থাকে নিজের সংসারের শান্তি বজায় রাখতে এমন করতে হয়। যদিও অমন ছেলেদের আমি নপুংষক কাপুরুষ ভাবি।

আমার মা ছোট হলেও বড়’র আগেই মারা গেছেন। সৎ মাকে আমি বড্ড’মা বলে ডাকতাম। উনি খুব সহজ সরল গ্রামের মানুষ ছিলেন। অনেক ছোটবেলার কথা। খুব বেশী মনে নাই। বড্ড’মা গ্রামের সওদাগর বংশের মেয়ে ছিলেন। নাম ছিল জুলেখা খাতুন। সওদাগর বাড়ির মেয়ে হলেও স্বভাবে একদম মাটির মানুষ ছিলেন। আমার স্কুলের বইতে একটা গল্প ছিল। যার লাইনগুলি এমন ছিল… জুলেখা বাদশা’র মেয়ে। তাহার ভারী অহংকার। আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করলেই আমি বড্ড’মার সামনে গিয়ে এসব কথা বলতাম। উনি তো আর জানত না যে আমি আমার বইয়ের কথা বলছি। উনি ভাবত আমি ওনাকে খেপানোর জন্য এসব বলি। উনি তখন বলত – আহাইরে যাদু, আঁই তঁর লগে কিয়া দেমাগ দেকাইসি। তুঁই কিল্লাই আঁরে এগিন কই মনে কষ্ট দেও। মন খারাপ করে ফেলত। আমি জড়িয়ে ধরলে আবার খুশি হয়ে যেত। তারপর ওনার বাপের বাড়ি থেকে আনা মুড়ির মোয়া বের করে খেতে দিত। পয়সা চাইলে একটা পিতলের চার কোনা পাঁচ পয়সা দিত। তখন পাঁচ পয়সা দিয়ে পাঁচটা মিষ্টি বাতাসা পাওয়া যেত। বড্ডমা’র পিতলের বদনায় ওনার নাম খোদাই করে লেখা ছিল … “ জুলেখা খাতুন, পিং গনু সওদাগর।” ওনার বাপের বাড়ি থেকে পাঠানো। সব সময় ছাই দিয়ে মেঝে ঘষে চক চকে করা থাকত সেই বদনা। পানি ভরা বদনাটা ওনার ঘরের সিঁড়ির পাশে থাকত। উনি অজু করতেন সেই বদনার পানি দিয়ে। আমি কোন কিছু না ভেবেই সেই বদনা নিয়ে বাড়ির পিছনে টয়লেটে চলে যেতাম। অন্য কেউ সেটা ধরার কথা কল্পনাও করত না। করলে তার কপালে শনির দশা নেমে আসত। কিন্তু বড্ডমা মা মরা ছেলে হিসাবে আমাকে অনেক বেশী আদর করতেন। শুধু বলতেন – আহাইরে এজিদা ( এজিদ), তুই আঁর অজুর বদনা নাফাক করি হালাইসত। তোরে আইজ হিডি হোতাই হালামু।কিন্তু ঐ কথা পর্যন্তই। কখনো আমাকে একটা চিমটিও দেন নাই।

সেই বড্ডমার সেজো মেয়ে মানে আমার আমি ও রেজু বুজি বোন,নাম হল রেজিয়া। আমি ডাকি রেজু বুজি। একেবারে বড্ডমার কপি। চেহারা, স্বভাব সব কিছুতেই। সৎবোন অথচ কেন জানি উনিও আমাকে অনেক আদর করত ইনফ্যাক্ট এখনো করেন। সৎবোন হলে কি হবে। আপন বোনের চাইতে বেশী আদর করে আমাকে। অবাক ব্যাপার হল, ঢাকা শহরের আমার অবস্থাপন্ন আত্মীয় বন্ধুরাও আমাকে সরাসরি ফোন করে না। ঢাকায় গেলেও খালি মিসড কল দেয়। কিন্তু আমার রেজু বুজি বাংলাদেশের অজ পাড়াগাঁ হাতিয়া থেকে আমাকে সরাসরি ফোন করে তাঁর মোবাইল থেকে। যদি জিজ্ঞেস করি, বুজি কিছু লাগবে আপনার? উত্তর দিবে – নারে, ভাই, আঁর কিসসু লাইগতো ন। আঁই খালি এক্কানা তোর গলা খান হুইনবার লাই ফোন কইচ্ছি। এমন কথা শুনে বুক ভারী হয়ে যায়। কে কার জন্য ভাবে আজ ? ওনার আরো কত ভাই বোন আছে। কিন্তু নিজের ছেলে মেয়েরা কোন অন্যায় করলে সেটাও উনি আমার কাছে নালিশ দেয় যেন আমি সব ঠিক করে দিতে পারব। এত আদর, এত বিশ্বাস আমার প্রতি ।

একবার ফোন করলে কত কথা বলে। কথার কোন শেষ নাই। আসলে ওনার কথা শোনার জন্য দেশে তো কেউ বসে থাকে না। ভাবে বুড়ো মানুষের প্রলাপ। আমি যখন একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মত নীরবে ওনার সব কথা শুনে যাই উনি খুব খুশী হন। পুরনো দিনের কথা বলেন। আমার মায়ের গল্প বলেন। মায়ের অনেক কিছু জেনেছি আমি এই বোনের কাছ থেকে। যদি জিজ্ঞেস করি, আমার নাম্বার কেমন করে ডায়াল করলেন । বলে, কেউ ওনার মোবাইলে সেইভ করে দিয়েছে। এখন উনি শুধু সেটা খুঁজে নিয়ে টিপে দিলেই চলে আসে। ছেলেরা সপ্তাহে সপ্তাহে মায়ের মোবাইলে মিনিট ফ্লেক্সি লোড করে দেয়। উনি সেটা খরচ করে বেশীর ভাগ সময় আমার সাথে কথা বলেই। যদি বলি ,আপনে রাখেন, আমি কল করি। উত্তর দিবে – আগে শেষ হউক, পরে কইরো।

মায়ের আদর মায়ের কাছ থেকে পুরোপুরি না পেলেও এদিক ওদিক থেকে চিটে ফোটা একদম কম পাই নাই। আমার স্কুলের বন্ধু সাইদের মা যার কথা আমার অনেক লেখায় উল্লেখ করেছি। খালাম্মা ডাকি। কিন্তু আসলে একদম মায়ের মত ভালবাসেন। সেই হাইস্কুল জীবন থেকে আসা যাওয়া শুরু আমার সেই বাসায়। 

খুব সৌখীন মানুষ তিনি। যখন আমি কলেজে পড়ি – সেই তখন থেকে ভারতের সুগন্ধি ‘বাবা জর্দা’ দিয়ে পান খেতেন খালাম্মা। এই জর্দার আবার আসল নকল ছিল। আমাকে নিউমার্কেট থেকে খুঁজে খুঁজে সেই আসল জর্দা কিনে আনতে হত খালাম্মার জন্য। এক কৌটা জর্দার দাম তখুনি পাঁচশ’ টাকা করে ছিল। তাই বলে ওনার খাওয়া বন্ধ হয় নাই।

বাসায় সব সময় সুন্দর কুঁচি করে ইন্ডিয়ান প্রিন্টের সুতি শাড়ি পরতেন খালাম্মা। তখন আমি খুব শাবানা আজমির ফ্যান। খালাম্মাকে দেখলে মনে হত শাবানা আজমির জমজ বোন। ভীষন নাক উঁচা মানুষ। সেই আমলে নিউমার্কেট, বায়তুল মোকাররমে শাড়ি কিনতে গিয়ে সব শাড়ি নামিয়েও একটা পছন্দ হত না। উনি নির্বিকার। দোকানের কর্মচারীরা ওনার ভয়ে একটা টু শব্দও করত না। কিন্তু আমার খুব লজ্জা লাগত। আমি বলতাম – খালাম্মা, এত শাড়ি নামিয়ে একটাও কিনলেন না কেন, আমার খুব লজ্জা লাগে এমন করলে । যেন কিছু হয় নাই এমন ভাব করে বলতেন –  শাড়ি গুলির জমিন ভাল না। আল্লাহ মালুম এটা দিয়ে কি বুঝাতেন।

খালাম্মা খালুর বয়সের অনেক ফারাক হলেও দু’জনের ভিতর ভাল আন্ডারষ্ট্যান্ডিং ছিল। সংসারের সব সিদ্ধান্তে যদিও খালাম্মার কথাই ফাইনাল কথা ছিল। তার উপর কথা বলার সাহস আর কারো ছিল না। কিন্তু কেন জানিনা আমার সাথে খালাম্মার অনেক খাতির ছিল। আমি অনেক বেশী প্রশ্রয় পেয়েছি খালাম্মার কাছ থেকে।

খালু সাহেব খালাম্মার সব সখের জিনিস কিনে আনতেন। খুব খেয়াল করতেন একে অপরকে। খালু মারা যাবার পর খালাম্মা এতই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যেন ওনারা দুইজন লাইলী মজনু ছিলেন। প্রবাস থেকে আমি প্রায় খালাম্মার সাথে লম্বা সময় গল্প করি। খালাম্মা এমনভাবে আবেগ আর শ্রদ্ধা, ভালবাসা নিয়ে খালুর গল্প বলেন যেন ওনারা দুইজন দীর্ঘকাল প্রেম করে তারপর বিয়ে করেছেন। অথচ উনি নিজেই বলেছেন তের বছর বয়সে খালুর সাথে ওনার বিয়ে হয়েছে। খালু অফিসে চলে গেলে উনি পুতুল নিয়ে খেলতে বসতেন। হ্যাঁ এটা আসলেই সত্যি কথা। আমিও উপলব্দি করেছি খালু সাহেব খালাম্মাকে অনেক ভালবাসতেন। দেখতাম দুজন সব সময় খুব সেজে গুঁজে, সুগন্ধি মাখিয়ে তারপর বেড়াতে যেতেন রিকশায় চড়ে। বেড়িয়ে ফিরে রাতের বেলায় খালাম্মার অভ্যাস ছিল সেভেন আপ খাওয়ার। তাই এখন খালাম্মা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন – জান মুরাদ, তোমার খালু সব সময় আমার জন্য সেভেন আপ নিয়ে আসতেন।

কত অল্পতে খুশী হতেন। শুনে আমার হাসি চলে আসলেও আমি হাসি চেপে রাখি।

খালাম্মা খুব পারফিউম ইউজ করতেন বেড়াতে যেতে। আমি বিদেশ থেকে দেশে যাওয়ার সময় ফোনে ওনাকে জিজ্ঞেস করতাম  – খালাম্মা, বলেন আপনার জন্য কি আনব ? বলতেন কিছু লাগবে না। বেশী পিড়াপিড়ি করলে আস্তে করে বলতেন – আচ্ছা, একটা সেন্টের শিশি আইনো। তোমার খালু সব সময় কিনে দিতেন।  কথার ভিতর কেমন একটা চাপা দুঃখ টের পাই। জিজ্ঞেস করি ওনার কোন বিশেষ পছন্দের সেন্ট আছে কিনা। বলে উনি তো কিনে আনতপ্লিজ কল মি মেক্সি।’

 ওটা আসলে অনেক পুরনো ব্র্যান্ড। অনেক খুঁজেও পাই নাই। অন্য সেন্ট কিনে নিয়েছিলাম। খুব খুশী হয়েছিলেন।

খালাম্মা প্রচন্ড গোঁড়া মানুষ। নিজের পছন্দের বাইরে সাত রাজার ধন কিনে দিলেও নিবে না। সারা জীবন দেখেছি দুই ফিতার পাতলা চটি পরে পায়ে। সেই ষ্টাইলের সামান্য হেরফের হলে আর পায়ে দিবে না। কাপড় চোপড়ের ফ্যাশন বদলে কোথায় চলে গেছে। কিন্তু আমার খালাম্মা এখনো ওনার আদি ষ্টাইল বজায় রেখেছেন। এখনো ইন্ডিয়ান প্রিন্টের শাড়ি পরে বাসায়। সব সময় সেগুলি ভাতের মাড় দিয়ে মচমচে করে ইস্তিরী করা হতে হবে। উনিশ বিশ হলে চলবে না।

খালাম্মা খালু খুব বাইরে বেড়াতে যেতেন। রেষ্টুরেন্টে খেতে যেতেন। এখন খুব যান না বাইরে। কিন্তু ধরে নিয়ে গেলে খুব খুশী হয়। চাইনিজ খুব প্রিয় খাবার। আজকাল শুনি ফাষ্ট ফুডের খাবারও নাকি খুব পছন্দ করেন রেষ্টুরেন্টে বসে খেতে। এখন ওনার অনেক নাতি নাতনি। ওরাই নানুকে ধরে নিয়ে যায়। পায়ের সমস্যার জন্য ভাল করে হাঁটতে পারেন না। কিন্তু তাই বলে কোন সখ আহ্লাদ বাদ দেন নাই। এখনো আগের মতই সুন্দর পরিপাটি করে ড্রেস করে সেন্ট লাগিয়ে তারপর বাইরে যান।

আমার শশুর শাশুড়ির গল্প শুনেছি। ওনারা ভারতের করিমগঞ্জ থেকে এসেছে। সিলেটের ভাষায় কথা বলে। শশুর মশাই টি এন্ড টিতে চাকুরি করতেন। সংসার তো শুধু নিজের ছেলে মেয়ে নিয়ে নয়। সাথে অনেক ভাই বোনও ছিল। তাই খরচ চালাতে ফকিরের পুল বাজারে একটা মুদি দোকান দিয়েছিলেন। এছাড়াও আমার শাশুড়ি নাকি খবরের কাগজের ঠোঙা বানিয়ে বাজারের দোকানগুলিতে সাপ্লাই দিতেন বাড়তি উপার্জনের জন্য।সেই উপার্জন জমিয়ে উনি খিলগাঁয়ে জমি কিনে বাড়ি বানিয়েছিলেন।

খুব সৌখীন মানুষ ছিলেন আমার শাশুড়ি। বিদেশ ঘোরার খুব সখ ছিল ওনার। আমি সেই বাড়ির জামাই হওয়ার আগেই উনি ইংল্যান্ড, সুইডেন ঘুরে এসেছেন। আমাদের প্রথম ছেলে হবার সময় আমার শাশুড়ি ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক চলে এসেছিলেন সেই চুরানব্বই সালে। ওনাকেও দেখেছি খুব বাইরে বেড়ানো, বাইরে খাওয়ার সখ ছিল। খুব খুশী হত বাইরে খাাবার কিনে নিয়ে আসলে। উনিও মজার মজার চকলেট পছন্দ করতেন।

হাঁটুর ব্যাথার জন্য ডাক্তার লাঠি ব্যবহার করতে বলেছে। কিন্তু উনি কখনো লাঠি ব্যবহার করতে চাইতেন না। নিজেকে দুর্বল ভাবতে রাজি ছিলেন না। প্রচন্ড মানষিক শক্তির অধিকারী এই মহিয়সী মহিলা। ওনার চার মেয়ের আদর ভালবাসায় উনি এখনো বেঁচে আছেন। তবে এখন আর চলা ফেরা করতে পারেন না। তার উপর সৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। কাউকে চিনতে পারে না। কিন্তু এখনো খুব হাসি খুশী থাকেন। একটাও দাঁত নাই। তবুও মাড়ি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খান পছন্দের খাবার। ভাল খাবার নিয়ে গেলে দেখেছি খুশিতে ওনার চোখ চকচক করে আনন্দে। বিদেশী চাদর, সুয়েটার নিয়ে গেলে পরে বসে থাকেন। খুলতে চান না।

আমার বাল্য বন্ধু মিন্টুর মা আমার আরেকজন প্রিয় মানুষ। মাতৃত্বের এক অদ্ভুত নিদর্শন দেখেছি ওনার ভিতর। ময়মনসিংহ এর মানুষ। আঞ্চলিক টানে কথা বলে। ফর্সা ধবধবে মানুষ। পান খেয়ে সব সময় ঠোঁট লাল করে রাখতেন। নাইন ইলেভনে এর সময় ফ্লোরিডা থেকে নিউইয়র্ক হয়ে ঢাকা ফেরার সময় আটকে পড়ে দুই দিন আমার বাসায় ছিলেন। ওনার সঙ্গ এত ভাল লেগেছিল আজো খুব মিস করি। এত আদর দিয়ে কথা বলেন, যা কিনা মনের ভিতর গিয়ে স্পর্শ করে। ‘বাজান’ বলে ডাকা ছাড়া কথাই বলে না। এরপর আর দেখা হয় নাই। দুই দিন ওনার যত্ন করেছিলাম, সেটা আজীবন মনে রেখেছে। মিন্টু দেশে গেলে আমার কথা জিজ্ঞেস করবে। আমার ছেলেদের খবর নিবে।

ওনার কিছু কথা মনে হলে আমার এখনো খুব হাসি আসে। নাইন ইলেভেনের ঘটনার পর পুরো আমেরিকা জুড়ে নিরাপত্তা বলয় তখন। মিন্টু খালাম্মাকে আমার বাসায় রেখে ফ্লোরিডাতে ফিরে গেছে। আমার দায়িত্ব ছিল যখন ফ্লাইট চালু হবে খালাম্মাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে কোন বাংগালীর সাথে পরিচয় করিয়ে প্লেনে উঠিয়ে দেয়া ঢাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য। এয়ারপোর্টে পৌঁছে বন্দুক ধারী সৈন্য দেখে ভয়ে আমার আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে পলানোর দশা। আমার সাহস হচ্ছিল না ঐ সেনাদের অতিক্রম করে এয়ারপোর্টের ভিতর ঢূকতে। তাই খালাম্মাকে বললাম, উনি যেন নিজেই ভিতরে গিয়ে কাউকে খুঁজে নেয়। আমি গেলে আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। এই কথা শুনে দেখি ওনার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল ভয়ে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে – বাজানরে আমারে ফালায়ে যাইস না। আমি মইরা যামুগা। শুনে আমি হো হো করে হেসে দিছিলাম। নিরুপায় হয়ে ওনার হাত ধরে ভয়ে ভয়ে এয়ারপোর্টের ভিতর পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম।

আমার বন্ধু নজরুলের বাবা বেঁচে থাকতে একবার আমার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। শীতের দিন ছিল। আমি ওনাকে একটা স্যুয়েটার উপহার দিয়েছিলাম। ভদ্রলোক এত খুশি হয়েছিলেন সেটা পেয়ে, চেহারায় সেই আনন্দ ফুটে উঠেছিল। বন্ধুর কাছে পরে শুনেছি, বাসায় যত মানুষ এসেছে সবাইকে ডেকে সেটা দেখিয়েছে এবং বলেছে সেই স্যুয়েটারটা নাকি সবচে আরামের। আসলে ব্যাপার সেটা নয়, উপহার পেয়ে ওনার মন ভরেছে, কথাগুলি ছিল তারই প্রতিফলন।

মানুষ বুড়ো হয়ে গেলেই যে সব সখ হারিয়ে যায় এটা সত্যি না। আমার বাবার যখন আশির উপর বয়স ছিল, অনেক হাই ডায়বেটিস ছিল তখনো দেখেছি বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে ক্রিম লাগানো বিষ্কুট খুলে জিহবা দিয়ে ক্রিম চেটে চেটে খাচ্ছে। আমরা দেখে ফেললে লজ্জা পেতেন।একদিকে ঔষদ খেত, ইনসুলিন ইনজেকশন নিত অন্যদিকে মিষ্টি কিছু দেখলে লোভ সামলাতে পারত না। খুব মায়া লাগত দেখে। কিন্তু আমরা এসব বুঝতে চাইতাম না।

মায়ের সন্মান সবার উপর। আমরা সবাই কি সেই সন্মান দেই? কতটুকু বোঝার চেষ্টা করি মায়ের সখ আহলাদ ? বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দেখি ছেলেদের কাছে মায়েরা গলায় আটকে যাওয়া হাঁড়ের মত। না পারে ফেলতে, না পারে গিলতে এমন অবস্থা। অথচ মা আজীবন একই রকম থাকে সব সন্তানের জন্য। মা আসলেই এক অমূল্য ধন পৃথিবীতে সব কিছু রিপ্লেইস করা সম্ভব শুধু মা রিপ্লেইসড হয় না।

ফেইসবুক থেকে পাওয়া একটা সত্যি ঘটনার অনুবাদ করেছি –

একুশ বছরের বিবাহিত জীবনে প্রতিবার বাইরে খেতে যাওয়া হয়েছে স্ত্রীর সাথেই। একদিন স্ত্রী তার স্বামীকে অনুরোধ করল অন্য এক মহিলাকে নিয়ে ডিনারে যেতে। হতবাক স্বামী জানতে চাইল কে সেই মহিলা। স্ত্রী তখন জানাল সেই অন্য মহিলা খুব খুশী হবেন তুমি তাঁকে ডিনারে নিয়ে গিয়ে তাঁর সাথে সময় কাটালে। তিনি তোমার মা। স্ত্রীর কথায় মনে পড়ে গেল নিজের কাজ, সংসার, সন্তান নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটানোয় মায়ের কথা মনেই ছিল না।

মা’কে ডিনারের দাওয়াত দিলে অবাক হলেও মা খুশী মনে যেতে রাজী হল। ডিনারের দিন ছেলে মা’কে আনার জন্য মায়ের বাড়িতে গেলে দেখে মা খুব সেজে গুঁজে অপেক্ষা করছে ছেলের জন্য। দু;জন একসাথে রেষ্টুরেন্টে গেল। মা এখন চোখে দেখে না ভাল। তাই ছেলে মেনু দেখে খাবারের অর্ডার দিল। চোখাচোখি হতে দেখে মা অপলক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছে। তারপর বলে – তুমি যখন ছোট ছিলে, পড়তে পারতে না। তখন আমি মেনু পড়ে অর্ডার দিতাম। এখন তুমি সেই কাজটা করছ। তুমি এখন আমার বাবা আর আমি তোমার মেয়ে। 

কথাগুলি শুনে ছেলের চোখে পানি চলে এল। অপরাধবোধ জেগে উঠল মনে। উনিশ বছর ধরে তার মা বিধবা জীবন কাটাচ্ছে একা একা। নিজে কখনোই মা’কে সময় দেয়ার কথা ভাবে নাই। তবুও মায়ের কোন অভিযোগ নাই। বরং আজ একসাথে খেতে এসে কতই না আনন্দ প্রকাশ করছে। ডিনারের পর মা’কে তাঁর বাসায় নামিয়ে দিয়ে ছেলে স্ত্রীর কাছে ফিরে এল।

কিছুদিন পর ছেলে ডাকযোগে একটা খাম পেল। খুলে দেখে মায়ের হাতের লেখা ছোট্ট একটা চিঠি। সাথে একটা রেষ্টুরেন্টের বিল। চিঠিতে লেখা আছে – খোকা, সেদিন তুমি খাইয়েছ। এবার আমার খাওয়ানোর পালা। কিন্তু আমার শরীরের যা অবস্থা, মনে হয় না বেশী দিন বাঁচব। তাই আমি একটা রেষ্টুরেন্টে দু’জনের খাওয়ার বিল পরিশোধ করে রেখেছি। তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে ওখানে গিয়ে খেয়ে এসো। আমি খুব খুশী হব।

– লাভ ইউ, তোমার মা।

 চিঠি যখন হাতে এসে পৌঁচেছে তার আগেই হার্ট এটাকে ছেলের মা মারা গেছে। চিঠিটা হাতে নিয়ে ছেলে বসে পড়ল। চোখ দিয়ে পানি গড়াাতে লাগল। এত বছর মা’কে সময় না দেয়ার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হল। অথচ মা কখনোই কোন অভিযোগ করে নাই। শুধু তাই নয়। ছেলে মাকে খাইয়েছে – সেই ঋন ও রেখে যায় নাই। ঋন শোধ করে তারপর চলে গেছে।

পৃথিবীর সব মা’ই এমন হয়। সন্তান আজীবন মায়ের চোখের মণি থাকে। সন্তানরাও মা’কে যদি এমন সন্মান দিত, তাহলে মনে হয় মা নিয়ে কারো কোন গল্প লেখার দরকার হত না।

৪ই ডিসেম্বর, ২০১৫