সোনার মানুষ
আমি সেই আমলের ঢাকা শহরের মানুষ হলেও অন্য বন্ধুদের মতো আমাদের বাসায় ডিসিপ্লিন, কেয়ার এসবের কিছুই ছিল না। বরং বাসায় ছোটদের উপর মাতবরি করার মানুষের অভাব ছিল না। একাধিক মায়ের ঘরের অসংখ্য আত্মিক টানহীন ভাইবোনের ভিড়ের ভিতর খড়কুটোর মত বাস করতাম। সেখানে কোন মায়া মমতা,আদর সোহাগ,ভালোবাসা এসবের স্থান ছিল না। বাসাটা অনেকটা চিৎ কাত বোর্ডিং এর মতো ছিল বলা যায়।

বৈচিত্রহীনভাবে প্রতিদিন তিনবেলা একইরকম খাবার খেতে বিরক্ত লাগতো আমার। বিরক্তিকর সেই খাবারও সময়মত খেতে না বসলে শেষ হয়ে যেতো। তখন গাল ফুলালে দেখার কেউ ছিল না।উপোষ কাটাতে হবে। তাই অবশিষ্ঠ যা’ই থাকতো,গলাধঃকরণ করে পেট ভরতে হতো। ঠিক এই কারণে মানে ভাল খাবারের লোভে মনে হয়, আমি বেশীরকম বন্ধু ঘেঁষা হয়ে পড়েছিলাম। কারো বাসায় একবার ভালো খাবারের সন্ধান পেলে সে বাসায় আমি খুব ঘন ঘন যেতাম।
স্কুল লাইফে যাওয়া শুরু হলো সাঈদের বাসায়। ওরা পাঁচ ভাইবোন। সাঈদ বাসার একমাত্র ছেলে। টের পেলাম ওদের বাসায় খাওয়া দাওয়া বেশিরকম ভালো হয়। ব্যস, আমি প্রায় রেগুলার হয়ে গেলাম ওদের বাসায়। একমাত্র ছেলের বন্ধু আমি। তাই বাসার সবাই আমাকে খুব আদর করতো। অবাধ বিচরণ ছিল আমার। সেই বিচরণ ইনফ্যাক্ট আমেরিকায় চলে আসার আগে পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

ইউনিভার্সিটি লাইফ পুরোটাই কাটিয়েছি হলে। হলের ডাইনিং কিংবা ক্যাফেটেরিয়ার খাবার আহামরি ভালো ছিল না। তাই মাঝে মাঝে বন্ধুরা দল বেঁধে নিউমার্কেট,নীলক্ষেত,চানখাঁরপুলে পুলের হোটেলে খেতে যেতাম। এছাড়া কিছু বন্ধুর বাসায় তো যেতামই। তাদের ভিতর রহমতের বাসার খাবার ছিল সেরা। খালাম্মা মানে রহমতের মায়ের রান্নার কোন তুলনা হয় না। তার উপর ওনার আন্তরিক পরিবেশনা আমাকে চুম্বকের মতো টানতো সেই বাসায়। ইউনিভার্সিটিতে মারামারি লাগলে সেটা হল পর্যন্ত গড়াতো। হলে গড়ালে মার খাওয়া থেকে বাঁচতে প্রায় হল ছেড়ে পালতে হতো। পালিয়ে নিজের বাসায় কখনো যেতাম না। প্রথম কারণ,তাইলে হলে ফিরে আসার ব্যাপারটা অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে। দ্বিতীয়তঃ মায়ের মায়া মমতাহীন সস্তা বোর্ডিং টাইপ বাসা, বাসার পরিবেশ এবং মানুষগুলি আমার একটুও ভাল লাগতো না। তাই আমি বন্ধুর বাসায় চলে যেতাম। কখনো সাঈদের বাসা,কখনো খোকার বাসার চিলেকোঠায়,নইলে রহমতের বাসায়।যে বাসায় যেতাম, অবচেতন মনে আমি বাসার মানুগুলিকে স্টাডি করে ফেলতাম। বুঝতে চাইতাম তাদের কাছে ছেলের বন্ধু হিসাবে আমার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। অনেকের বাসায় বন্ধুদের মা বাবা কখনো দেখা দিতো না।দেখা হলেও বিরক্ত কিংবা ঠান্ডা চাহনি দিয়ে চলে যেত। বন্ধুর রুমে কাজের মানুষের হাতে খাবার পাঠাতো। তাতে আমার কোন ক্ষোভ ছিল না। থাকার কথাও নয়। থাকতে পারছি,খেতে পাচ্ছি সেটাই যেন ঢের পাওয়া।
ব্যতিক্রম ছিল সাঈদের পরিবার। ওদের বাসার সবার সাথে আমার খুব আন্তরিক সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে। ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম ওদের বাসার সব কর্মকান্ডের সাথে। অসাধারণ বড় হৃদয়ের মানুষ সাঈদের মা বাবা,বোনেরা সবাই। আর মজা পেতাম রহমতের বাসায় গিয়ে। রহমতের বাবা একজন অসাধারণ ভালো মানুষ ছিলেন। ওনাকে কখনো বিরক্ত হতে দেখি নাই এই জীবনে। ছেলের বন্ধু হলেও আমাদেরকে উনি যথেষ্ঠ স্নেহ শুধু নয়,সন্মান ও দিতেন। কত ঘটনা মনে পড়ে।মনে পড়ে আবেগতাড়িত হই।সেই সব দিনে কারো বাসায় যাওয়ার আগে, আগে থেকে যোগাযোগ করার কোন উপায় ছিল না। ওদের বাসায় ফোন ছিল। কিন্তু আমার তো ফোন করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। হলের পে ফোন মাস্তানরা খুলে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে। অফিস রুমের ফোন ব্যবহার করতে দেয় না প্রভোস্ট। অতএব,রিস্ক নিয়ে রিকশায় চড়ে নীলক্ষেত থেকে লালবাগে গিয়ে হাজির হতাম। কখনো ওকে বাসায় পেতাম। কখনো পেতাম না। না পেলে মন খারাপ হতো রিকশা ভাড়া গচ্চা যাওয়ায়। কিন্তু না, বিফল হয়ে ফিরতে হতো না। রহমতের বাবা খুব ভদ্রভাবে আমাকে জানাতেন যে রহমত বাসায় নাই। তবে আমি চাইলে ওর জন্য ওয়েট করতে পারি তার ঘরে গিয়ে। আমি অবশ্যই সেই অফার লুফে নিতাম। প্রথম কারণ রিকশা ভাড়াটা হালাল হবে চা নাস্তা খেয়ে। এর ভিতর রহমত ফিরলে আড্ডাটাও হয়ে যাবে। রহমতের দাদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলে দারোগা। চিটাগাং থেকে ঢাকায় এসে লালবাগে বাসা বাঁধেন। কেল্লার বিশাল দেয়ালের পিছনে কেল্লার মতোই বিশাল জায়গা নিয়ে পুরোনো আমলের দালানে ওদের বাসা। ৩২/২,হাজি রহিম বক্স লেইন। খালুকে নাকি ছয় বছর বয়সে ঢাকায় নিয়ে আসেন ওনার বাবা। পুরান ঢাকার ভিন্নধর্মী পরিবেশে মানুষ হয়ে খালু মোটেও ঢাকাইয়া কুট্টিদের মতো হন নাই। ভালো লেখাপড়া শিখেছেন।কেতাদুরস্ত হয়েছেন। ভদ্রলোক শুধু স্কুল কলেজের সার্টিফিকেটের লেখাপড়া শিখেন নাই। শিখেছেন সত্যিকারের আধুনিক,মানবিক শিক্ষা। এতো নম্র,ভদ্র মানুষ আমি জীবনে খুব কম দেখেছি।ঠিক নিজের মতো করে মানুষ করেছেন খালু তার নিজের ছেলে মেয়েদেরও। অবাক কান্ড হলো,ওরা কেউই ঢাকাইয়া হলো না। হয়েছে আধুনিক পোলাপান। শুধু শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে না – খাওয়া দাওয়াও অতিমাত্রায় আধুনিক যা কিনা আমি খুব কম বাসায় দেখেছি। তারচেয়ে বড় কথা হলো ,খালু রহমতকে বানিয়েছে একটা জ্ঞানের পাহাড়। এতো জানে ছেলেটা যে আমি ওর সাথে চলা ফেরা করে শুধু অবাক হতাম।

খালুর কথায় ফিরে আসি। তিনি শুধু রহমতকে সব শিক্ষায় শিক্ষিত করে ছেড়ে দেন নাই। দেখেছি বাবা ছেলের ভিতর খুব সুন্দর বন্ধুর মতো সম্পর্ক। সেই আমলে এমন আমি আর কোথাও দেখি নাই। আমরা আড্ডায় বসলে খেয়াল করতাম,খালুও যেন পারলে আমাদের সাথে বসে পড়ে আর কি। উনি বুঝতেন আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা, তাই চলে যেতেন।

পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন। অথচ আচরণে ছিলেন একজন কেতা দুরস্ত বড় অফিসারের মতো পলিশড মানুষ উনি।

রহমতের চলা ফেরা ছিল জমিদারের মতো। গায়ে গতরে মোটা সোটা মানুষ সে। খাওয়া দাওয়ায় খুব নাক উঁচা স্বভাবের। বাসায় খাবার পছন্দ না হলে না খেয়ে রাগ করে হলে চলে আসতো। এসে আমাদের টং দোকানের বনরুটি আর কলা খেত।দেখে আমি হাসতাম।

এক সময়ে আমরা সবাই লেখাপড়া শেষ করে ভার্সিটি ছাড়লাম। রহমত বিয়ে করলো আমাদের অনেকের আগে। তাতে আমাদের সম্পর্কে কোন ভাটা পড়ে নাই। অল্প কিছুদিন ঢাকায় চাকরি করে একদিন আমি পাড়ি জমালাম দেশের বাইরে। প্রবাস থেকে প্রিয় বন্ধুর সাথে কথা বলার জন্য ফোন করতাম। খালু ফোন ধরলে সাথে সাথে আমাকে চিনে ফেলতো। সব খোঁজ খবর নিতো আমার। তারপর রহমতকে ফোন দিতেন।

আমার প্রতি কারো মায়া হলে আমি খুব টের পেতাম। অনুভব করতাম মনের ভিতর। কৃতজ্ঞ হতাম। আদর পাওয়া নেড়ি কুকুরের মতো মনের ভিতর কুঁই কুঁই করে তৃপ্তির সুর তুলতাম। এমন মায়া আমি অনুভব করেছি মাত্র দুইজন মানুষের কাছে থেকে। একজন হলো সাঈদের বাবা। আরেকজন হলো রহমতের বাবা। দুজনেই ট্রু জেন্টেলম্যান ছিলেন। অবাক কান্ড হলো এই দুজনেই আমার সাথে অনেক গল্প করতেন বন্ধুর মতো।

প্রবাস থেকে দেশে বেড়াতে গেলে অবশ্যই আমি এই দুইজন মানুষের সাথে দেখা করতাম সব সময় নিজ তাগিদেই। ওনারা খুশি হতেন। আমিও ভাল ফিল করতাম। অবাক হয়েছি, শেষবার সাঈদের বাবার সাথে দেখা হলে উনি যেভাবে আমার হাত

ধরে আপন মানুষের মতো কথা বলেছিলেন, এমন করে কেউ শুধু নিজের ছেলের সাথেই বলে। ভদ্রলোক আমাকে ঋনী করে চলে গেছেন ওপারে। কামনা করি ওপারেও যেন তিনি অনেক ভালো থাকেন।সব সময় না পারলেও প্রায়ই দেখা করতাম রহমতের বাবার সাথে। গত এপ্রিলে দেশে গেলাম। ওনাদের সাথে দেখা করতে গেলাম। ওদের লালবাগের বিশাল বাড়িটা আর নাই। শ্যামলীতে থাকে সবাই। রহমতের ভাইবোনেরা আমাকে চেনে ছোটবেলা থেকে। তাই যে যার পরিবার নিয়ে সবাই জড়ো হয়েছে। ভাল লাগছিলো সবার এতো আন্তরিকতা দেখে। খালু দীর্ঘদিন নানা রকম শারীরিক জটিলতা নিয়ে শয্যাশায়ী। ওয়াকিং স্টিক দিয়ে কারো সাহায্যে এক আধটু হাঁটেন কখনো সখনো। খালুর বেডে বসে অনেক্ষন গল্প করলাম। এতো অসুখ তারপরেও স্মৃতি খুব প্রখর। আমার স্ত্রীর নাম ধরে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলেন সে কেমন আছে। নাম মনে রেখেছে দেখে খালাম্মাও অনেক অবাক হলেন। খালাম্মা খালু প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন। তাই ওনাদের সম্পর্কের ভিতর অনেক খুঁনসুটি চলে খেয়াল করেছি।

গল্পের এক পর্যায়ে খালু আগের দিনের ঢাকার গল্প বলতে গিয়ে অকল্পনীয় এক তথ্য দিয়ে আমকে অবাক করে দিলেন। এর আগে আর কোন ইতিহাসে এই খবর পড়ি নাই। তিনি জানান, ধানমন্ডিতে একসময় শুধু ধানক্ষেতই ছিল না – ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে ছিল প্লেইন উঠানামার জন্য রানওয়ে ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই রানওয়ে দিয়ে যুদ্ধ বিমান উঠানামা করতো। বিস্তারিত শোনার আগে খাবারের টেবিলে ডাক পড়লো।

খালু নিজের বেড ছেড়ে নড়ে না। কিন্তু সেদিন আমাকে দেখে খুব একসাইটেড হয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনিও লাঠিতে ভর দিয়ে খাবার টেবিলে এসে বসে পড়লেন। খুব ভালো সময় কেটেছিল সেদিন। ইচ্ছা ছিল আরেকদিন গিয়ে পুরো গল্প শুনার। কিন্তু সময় হয়ে উঠে নাই। সেই গল্প আর কোনোদিন শোনাও হবে না। কারণ মানুষটা এইতো কয়দিন আগে সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। খুব মিস করবো মানুষটাকে। আসলেও ভালো ছিলেন। অন্যরকম ভালো মানুষ তিনি। বিরল প্রকৃতির ভালো। এমন আর দেখা যায় না আজকের দুনিয়ায়।

আল্লাহ ওনাকে জান্নাতবাসী করুক কামনা করি।

২২শে এপ্রিল, ২০১৮