হ্যাপী মাদার্স ডে
আজ মা দিবস। নূপুর তার একমাত্র শিশু কন্যা নিধিকে সাথে নিয়ে অফিসে এসেছে। আর কোন উপায় ছিল না।মা দিবস উপলক্ষে ডে কেয়ার সেন্টার বন্ধ।
নিধি মা’কে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য নিজের হাতে বানানো কার্ড, জমানো পয়সা দিয়ে গিফট কিনে বুক ব্যাগে লুকিয়ে রেখেছে। রাতে বাসায় ফিরে মা’কে সারপ্রাইজ দিবে।
নূপুরের সাথে নিধিকে দেখে অফিসের কর্তারা বিরক্ত হলেও মা দিবস বিধায় মেয়ে নিয়ে অফিসে আসা নিয়ে কেউ কিছু বলে নাই। কলিগেরা সবাই নিধির সাথে হেসে খেলে সময় কাটালো।
সন্ধ্যায় অফিস শেষে মেয়ের হাত ধরে রাস্তায় বের হল নূপুর | এই সময় প্রচন্ড জ্যাম থাকে গুলশান এভ্যিনিউতে | দেখলে মনেই হয় না এটা গুলশান। মনে হয় যেন গুলিস্তানের বাস ষ্ট্যান্ড| ক’দিন আগেই সকালে রাস্তা পার হতে গিয়ে এক গাড়ির ধাক্কায় ডান হাতের হাঁড় ভেংগেছে। ধাক্কা মেরে গাড়ির চালক দাঁড়ায় নাই | নির্বিকারভাবে পালিয়েছে। সেই ভাংগা হাত এখনো কাঁধের সাথে স্লিং এ ঝোলানো।
এক সপ্তাহের বেশীতো আর সিক লিভ নেয়া যায় না। সিংগেল মাদার নূপুর মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকে। তাই সপ্তাহ শেষে ভাংগা হাত নিয়েই মেয়ে্কে স্কুলে নেয়া, অফিস করা শুরু করেছে। করতে হয়েছে। ভাগ্যিস বাঁ হাতে কমপিউটারে টাইপ করতে জানে, তাই রক্ষা। নইলে খামোকা অফিসে আসলে শুধু চেহারাই দেখানো হত।
অনেকক্ষন অপেক্ষা করে দাম ঠিক করে একটা রিকশা নিল। প্ল্যান হল,আগে মার্কেটে গিয়ে নিজের মায়ের জন্য কিছু কিনবে। তারপর নাখালপাড়ায় মা’কে দেখতে যাবে।
রিকশায় উঠে বসতেই চালক তাকে সিট বেল্ট বেঁধে নিতে বলল।
নূপুর বলে – লাগবে না। অভ্যেস আছে।
চালক আবারও বলে – বেল্ট বানলে নিরাপদ থাকবাইন। উপ্তা অইয়া পইরা দাঁত বাংবো না।
নূপুর বিরক্ত হয়। বলে – কথা কম বলে সাবধানে রিকশা চালান।
রিকশাওয়ালা গজ গজ করে বলে – গরীবের কতা বাসী অইলেই ফলে। বলে রিকশায় প্যাডেল মারা শুরু করল |
কিন্তু যাবে কোথায় ! একটুখানি এগিয়ে জ্যামে আটকে থাকল। অস্থির ভ্যাঁপসা গরম। তার উপর গাড়ি ঘোড়ার হর্নে পিচ্চি নিধি ভ্যাঁ করে কাঁদা আরম্ভ করে দিল। নূপুর তাকে ধমক দিয়ে থামাতে চাইল।
কাঁদা থামিয়ে নতুন খেলতে শেখা Scrabble game নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে মায়ের মাথা খারাপ করে দিল। তার কথা হল সেদিন তার আংকেল একটা শব্দ বানিয়েছে heir. যার মানে নাকি উত্তরাধিকারী। ওটা কেন hear or here হল না। এসব নিয়ে তার কৌতহলের শেষ নাই। সামনে গাড়ি এগুতে একটু ফাঁকা হতেই রিকশা জোরে টানা আরম্ভ করল।
বাতাস লেগে যখন স্বস্তি অনুভব করা শুরু করল ঠিক তখুনি বিপত্তি বেঁধে গেল। পেছন থেকে একটা গাড়ি এসে খুব জোরে ধাক্কা মারল রিকশায়। রিকশা ছিটকে একপাশে গিয়ে উল্টে গেল। নূপুর ছিটকে পড়ে আরেক হাত ভেংগে রাস্তায় পড়ে জ্ঞান হারাল | ধাক্কার চোটে নিধি নূপুরের হাত থেকে ছুটে গিয়ে শূন্যে উড়ে গেল। রিকশাওয়ালা চাকার সাথে আটকে পা কেটে রক্ত ঝরাচ্ছে।
পেছনের গাড়ি থেকে বের হয়ে এল এক যুবক। কেতা দুরস্ত পোষাক পরা। গাড়ির ভিতর পাশে সুন্দরী বান্ধবী বসা। নেমেই গাড়ির কি ক্ষতি হয়েছে সেটা দেখতে ব্যস্ত হল। দামী গাড়ির রং উঠে গেছে ঘষা খেয়ে। একটা সাইড লাইট ভেংগেছে। রেগে গিয়ে সে রক্তাক্ত রিকশাওয়ালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিজের ভুল বেমালুম ভুলে গেল দাপটের চোটে।
গালি দিয়ে বলে – শুয়োরের বাচ্চা, দেখ তুই আমার বি,এম,ডব্লিউর কি ক্ষতি করেছিস ! তারপর আহত রিকশাওয়ালাকে লাথি মারতে শুরু করে।
ট্রাফিক সার্জেন্ট এগিয়ে এসে তাকে নিবৃত্ত করে বলে – স্যার,আপনার হাত পা ময়লা হচ্ছে। ছেড়ে দেন। আমি তাকে ধরে থানায় নিয়ে যাচ্ছি। আপনি বাসায় চলে যান।
সার্জেন্ট হুইসেল বাজিয়ে রাস্তা খালি করে গাড়ি ওয়ালা অপরাধী যুবককে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। তারপর রিকশাওয়ালাকে এরেষ্টের হুমকি দিয়ে তার পকেট থেকে সারাদিনের আয়ের পয়সা কেড়ে নিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়।
এদিকে রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ে জ্ঞান হারানো নূপুরকে আশেপাশের পথচারীরা ধরে পাশের এক ক্লিনিকে পৌঁছে দেয়। দুই হাত ভাংগা নূপুর একবার জ্ঞান ফিরে পেয়েই চিৎকার করে উঠে -আমার নিধি সোনা কই ? তারপর আবার জ্ঞান হারায়। নার্সরা সবাই কিছু না বুঝে পাগলের প্রলাপ মনে করে হেসে দেয়।
নিধি যখন ছিটকে আকাশে উড়ে গেল তার ছোট্ট পাখীর মত শরীর নিয়ে, ঠিক তার কিছু দুরে জ্যামে আটকে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মিনিবাস। ড্রাইভারের পাশে বসা ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিরক্ত মনে মোবাইল দেখছিল। পেছনের সিটে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে আড়মোড়া ভাংতে গাড়ি থেকে বের হয়ে হাত পা নাড়ছে সাকিব,সৌম্য, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।
হটাৎ উপরে চোখ যেতেই সাকিব দেখে কি যেন উড়ে নেমে আসছে।
সাকিব মাসরাফিকে জিজ্ঞেস করল – ওস্তাদ, কি যেন একটা উড়ে নেমে আসছে । ক্যাচ ধরব ?’
মাশরাফি মাথা বের করে একবার পজিশন দেখে নিল পতনের। তারপর একশনে চলে গেল। সবাইকে গাড়ি থেকে নেমে ক্যাচ ধরার জন্য পজিশন নেয়ার জন্য হাত নেড়ে ডিরেকশন দিতে লাগল চিল্লিয়ে। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল টাইগাররা ক্যাচ ধরতে।
সাকিব চিৎকার করে বলে – ওস্তাদ, আমার হাতে পড়বে,মনে হয়। আমি লমু ?
মাশরাফি শান্ত গলায় বলে – না, তুই আজকাল বেশী মিস করস। রিয়াদরে ধরতে দে।
একটু পর নিধি মাহমুদুল্লাহর দুইহাতের উপর নিরাপদে ল্যান্ড করল। সে অবাক হয়ে পিচচি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, এই শিশু কি আল্লায় আমারে দিল নাকি !
নিধি নিরাপদে ল্যান্ড করেই বলে উঠল – আম্মুর কাছে যাব। আম্মু রিকশায় বসে আছে।
বাংলাদেশ টাইগারদের পুরো টিম তখন নিধির মাকে খুঁজতে লাগল ভীড়ের ভিতর নিধিকে কোলে নিয়ে। লাল সবুজ জার্সি পরা টাইগারদের দেখে সেই পুলিশ সার্জেন্ট দৌঁড়ে এসে স্যালুট দিল। জিজ্ঞেস করল – স্যার ,আপনাদের কোন হেল্প লাগবে?
মাশরাফি বলল – হ্যাঁ এই ছোট মেয়েটার মা’কে খুঁজে বের করুন। সার্জেন্ট জানাল তাঁর আহত মা’কে পাশের হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
টাইগাররা সবাই তড়িঘড়ি করে সেদিকে দৌঁড়াল। ইমার্জেন্সিতে খোঁজ নিয়ে আহত নূপুরকে খুঁজে বের করল। সে তখনো অবহেলায় বেওয়ারিশ হিসাবে বারান্দায় পড়ে ছিল।
নিধি চিৎকার করে উঠল – ঐতো আমার মা। টাইগার্স, তোমরা আমার মা’কে বাঁচাও।
নিধির কথায় সবার মন ভিজে গেল। মাশরাফি ডিউটি ডাক্তারকে ডেকে বকা ঝকা করল, আহত নূপুরকে অবহেলায় ফেলে রাখার জন্য। হাসপাতালে ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল। নূপুরকে কেবিনে নেয়া হল। প্রাইমারী চিকিৎসা দেয়া শুরু হল। অবস্থা ষ্টেইবল হলে নিধি সবাইকে নিয়ে কেবিনে গেল। সবাই নিধিকে মাঝখানে রেখে নূপুরের বেডের চারপাশে ঘিরে দাঁড়াল। নূপুর একবার চোখ মেলে তাকালো। দেখল অনেকগুলি লাল সবুজ পতাকার ভিতর তার নিধি সোনা হাসিমুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে মেয়েকে ধরতে গিয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল।
মায়ের চোখ খুলেছে দেখে নিধি বলে উঠল – মা দেখো, তোমার জন্য কি গিফট এনেছি মাদার্স ডে’তে। পুরো টাইগার্স টিম নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। ভাল করে তাকিয়ে দেখো।
পুরো টিম একসাথে বলে উঠল – হ্যাপী মাদার্স ডে, নূপুর। উই অল আর হিয়ার টু চিয়ার ইউ আপ।
অষুধের ঘোরে নূপুরের মনে হল সে স্বপ্ন দেখছে। মিরপুর ষ্টেডিয়ামে টাইগাররা সবাই নিধিকে নিয়ে খেলছে। আনন্দে তার দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করল। তারপর মনে হল, আরে ধুর এটা কি সম্ভব নাকি ! সে নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে। তারপর আবার জ্ঞান হারালো ব্যথায়।
১৭ই জুন, ২০১৭