হল জীবনের খাওন দাওন

ফার্স্ট ইয়ারে বাসা ছেড়ে হলে থাকতে আসার পর সব কিছু ভাল লাগছিলো শুধু খাওয়ার কষ্ট ছাড়া। শুরুতে থাকার জায়গা পেলাম গণভবনে। মানে ডাইনিং হলের পাশে একটা হলরুমে সার বেঁধে রাখা চোকিগুলির একটায়। তাও একা না, ডাবলিং করতে হতো।

গণভবনের বিছানায় শুয়ে পাশের ডাইনিং হলের খাবারের দুর্গন্ধ পেতাম।

তাজা খাবারের আবার দুর্গন্ধ হয় নাকি ! হ্যাঁ হয়।

হলে গিয়ে সেটা জীবনে প্রথম টের পেলাম। প্রথম যেদিন খেতে গেলাম, ডাইলের কোন তলা খুঁজে পাই নাই। ডায়রিয়া হইলে অনেকবার টয়লেটে যাওয়ার পর পেট প্রায় খালি হয়ে এলে শেষ মেষ যে হলদেটে পানি বের হয় – ডাইলের চেহারা ছিল সেইরকম। এক সের ডাইলে মনে হয় কয়েক মন পানি আর হলুদ মিশিয়ে সেদ্ধ করে করে টেবিলে দিয়ে দিত আর কি। মাছ মাংস খাওয়ার যোগ্য ছিল না। হাড্ডি আর কাঁটা ছাড়া ভাল কিছু খুঁজে পাওয়া যেত না। কোনোভাবে মুখে দেয়া যেত না। নিজে থেকে উগলে বের হয়ে আসত। তাই একদিন গিয়ে আমি আর কোনদিন হলের ডাইনিং রুমে খেতে যাই নাই।

মনে মনে খুব কষ্ট অনুভব করছিলাম। কিন্তু কাউকে কিছু বলি না। রণে ভঙ্গ দিয়ে ব্যাগ নিয়ে তিন টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে বাসায় ফিরে যেতে চেয়েও পারি নাই। তাইলে অন্য মজা মিস করা হবে। তাই সেটা করলাম না।

সকালের নাস্তা খাওয়া সহজ ছিল। জয়নাল মিয়ার ক্যান্টিনের নাস্তা খারাপ ছিল না। সেটার ভাগ পেতে হলে ভোরে উঠতে হয়। সেটা তো সম্ভব ছিল না। সারা রাত ধরে রাজ কার্য করে ভোরে উঠি কেমনে ! তাই নাস্তা বলতে কপালে জুটতো ইয়াসিন মিয়ার দোকানের কলা আর বনরুটি। বড় জোর স্বপন ভাইয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে ডিম পরোটা।

প্রতিদিন দুপুর আর রাতের খাবার নিয়ে গবেষণা চলতো – আজ কোথায় খাওয়া যায়।

অনেকে তখন যার যার রুমে রান্না করতো ইলেকট্রিক হিটার জ্বালিয়ে। এই হিটারের লাল আভা দেখলেই আমার ভয় লাগতো না জানি কখন কারেন্টের শক খেয়ে পুড়ে কয়লা হয়ে যাই।

আমি আর ডালিম তখন সুর্যসেনের এক রুমে থাকি। রুম নম্বর ৩১৬। অন্যদের দেখাদেখি আমরাও রুমে রান্না শুরু করলাম। শুরুটা হল আমাদের ফুল টাইম এসিস্ট্যান্ট টোকাই হাশেমকে দিয়ে।সে রাঁধতে পারতো ভাত,ডাল আর আলুভর্তা – এইটুকুই। কদিন খাওয়ার পর আর ভালো লাগে না। রুম নোংরা হয়। তাই বাদ দিলাম।

ক্যাম্পাসে থাকলে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া, টিএসসি, ঢাকা মেডিকেল ক্যান্টিন যখন যেটার কাছাকাছি থাকতাম সেখানে খেতাম। আর না হয় স্বপন ভাইয়ের ক্যাফেটেরিয়ার বিরক্তিকর বিস্বাদ খাবার। মুরগির এক টুকরা হেলিকপ্টার, এক প্লেট ভাত আর ডালের প্যাকেজের দাম ছিল পাঁচ টাকা। হাফ প্লেট ভাত বেশি নিলে আট আনা বেশী লাগতো। ক্ষুধা বেশী থাকলে সেই হাফ নিয়ে ডাল আর কাঁচামরিচ ঘষে খেয়ে ফেলতাম।

ছবিতে দেখেন আমার সামনে একটা হাফ প্লেট ভর্তি কাঁচা মরিচ।এছাড়া আছে লবনদানি। আর খালি হাফ প্লেটটা হল ডালের। আমি অনেক বেশি খেতে পারতাম না। এত শুকনা ছিলাম যে যেন ওজন বাড়ে সেজন্য জোর করে পরের হাফ প্লেট ভাত খেতাম।

দুপুর এবং রাতের খাবার খেতে কই যাব, কি খাবো ভাবতে হত। টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার সাপ্লাইয়ের সার্ভিস ছিল। কয়দিন খেলাম। কিন্তু ভাল লাগতো না।

তারপর আবিষ্কার করলাম ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে ভাল খাবারের ব্যবস্থা আছে। তাদের ডাইনিং থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার আনাতাম। এই খাবারটা সাধারণত রাতের জন্য লাগত। সারাদিন টো টো করে ঘুরে মাঝ রাতে ফিরে এসে খাবার খুঁজতে ভাল্লাগতো না। তাই ব্যবস্থা করেছিলাম যেন রুমের সামনে ওরা খাবারের টিফিন ক্যারিয়ার রেখে যায়। রাতে হলে ফিরে এসে সেই ভাত অনেক সময় পেতাম না। বেশী রাত করে ফিরলে বন্ধুরা ভাবত আমি মনে হয় বাসায় গেছি তাই বাসা থেকে ভাত খেয়ে আসবো। তেমন ভেবে কেউ বিশেষ করে লক্ষীপুরের স্বপইন্যা আমার ভাত খেয়ে ফেলতো। একদিন এসে দেখি স্বপন অর্ধেক ভাত চেয়ে বাকিটায় মনে হয় হাত ধুয়েছে। বাটি খুলে দেখি পানিতে ভেজানো ভাত তরকারী। প্রচন্ড ক্ষুধা ছিল তাই সেই পানিতে ভেজা এঁটো ভাত খেয়ে নিয়েছি আমি। আর যদি কখনো খেতে না পারতাম, তখন পানি খেয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকতো না।

নতুন নতুন খাবারের দোকানের সন্ধান পেতাম বন্ধুদের কাছ থেকে। ছুটতাম সেখানে খেতে। ভাল লাগলে বার বার যেতাম। না হয় বাদ। পরিবাগে ইকরারদের বাসার পাশে একটা ছাপরা হোটেলে খেতে গেলাম একদিন।খেতে বসে নাকে ড্রেনের গন্ধ পেয়ে আর খেতে পারলাম না। এখন যেখানে আজিজ সুপার মার্কেট, সে জায়গায় বিশাল খাল ছিল ময়লা পানির। সেই ময়লা পানির গন্ধে পেতে খাবার নামতে চাইতো না।

ঢাকা কলেজের উল্টা দিকে চিটাগাং হোটেলের গরুর মাংসটা দারুন লাগতো। ওখানে খেতে যেতাম মাঝে মাঝে।

মহসিন হলের গেটের পাশে কিছুদিন একটা ছাপরা হোটেল চালু ছিল। অতি সস্তা কিন্তু মজার খাবার ছিল। অবৈধ বলে ওরা বেশিদিন টিকতে পারলো না।

নিউমার্কেটের কাঁচা বাজারের পিছনে একটা ঘুপচি হোটেল ছিল। দারুন মাছ রান্না করতো অনেক ঝাল দিয়ে। যেতাম কিন্তু সব সময় অতদূরে খেতে যেতে ইচ্ছা করতো না। তাছাড়া রিকশা ভাড়া খরচ করে কে আমাদের লিমিটেড বাজেটের টাকায়।

সেই সময়ে আমাদের বাজেটে সবচেয়ে বিলাসী খাবারের জায়গা ছিল চাঁনখার পুলের নীরব হোটেল। তাদের ঝুরি পরোটা, মগজ ভুনা, কলিজা, গরু খাসী, ভর্তা ভাজি সব খাবার সিমপ্লি অসাধারণ স্বাদের ছিল। পরিমাণে খুব অল্প দিত। আমরা সেই অল্প তরকারী দিয়ে ঘষে ঘষে প্লেটের সব ভাত খেয়ে ফেলতাম।

নীরব এ খেতে যেতাম শুধু পরীক্ষার দিনে। মনে হত, পরীক্ষার আগে ভাল খাওন দরকার। তো সেই খাওনের নাম হয়ে গেল ‘ইম্প্রুভ ডায়েট’। মাঝে মধ্যে খেতে যেতাম এক রিকসায় তিনজন করে বসে। নীরবের খাবার খেয়ে একটা ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের পুরোটা একা টানতে পারা অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল তখন। এমনি সারাক্ষণ স্টার সিগারেট, শুধু লাঞ্চ ডিনারের পর ভাগাভাগি করে ফিলটার দেয়া দামী সিগারেট টানতাম আর কি !

বিজয়নগরে ‘কবির হোটেল’ নামে একটা মারাত্বক বেশী দামের মারাত্বক ভাল খাবারের দোকান ছিল। এক টুকরা মাছের পেটির সাইজ ছিল ছয় থেকে আট ইঞ্চি মাপের। একবার খেতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেছিলাম। পকেটে পয়সা ছিল না এনাফ। ভাগ্যিস হলের জিএস বন্ধু খোকন এসে হাজির হয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিল সে যাত্রা।

অনেকবার কালী মন্দিরের স্টার কাবাবের নাম শুনেছি। ওদের বিরিয়ানি নাকি জগত সেরা। তাইলে তো খেতেই হয় একদিন। সবার পয়সা এক জায়গায় করে একদিন খেতে গেলাম সেই স্টার হোটেলে। খেয়ে দেয়ে বিল দিয়ে গিয়ে আবিষ্কার করলাম হোটেলটার মালিক আমাদের প্রিয় বন্ধু দুলালের বাপ। সেদিন আর পয়সা দেয়া লাগে নাই। তবে বন্ধুর হোটেল বলে লজ্জায় আর খেতেও যাই নাই। কারণ তখন পকেটে এনাফ টাকা থাকতো না আমাদের।

আমরা তখন ছাত্রদল করি। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে পার্টি অফিসে ডিনার খাওয়ার দাওয়াত পেলাম। এমন দাওয়াত পেয়ে তো আমাদের মূর্ছা যাওয়ার যোগাড়। মনে মনে ভাবলাম কি আলিসান খাবারটাই না খাবো। সবাই সবার সেরা জামা কাপড় পরে গেলাম ধানমন্ডির পার্টি অফিসে। অনেক জ্ঞান দেয়া কথা শুনলাম। আমাদের কানে ওসব কিছুই ঢুকছিল না। অপেক্ষা করছিলাম কখন খাওয়া সার্ভ করবে সাদা উর্দু পরা ফাইভ স্টার হোটেলের বেয়ারারা ! অবশেষে খাওয়া এলো। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। লঙ্গরখানায় এর চেয়ে ভাল খাবার খেতে দেয়। সাদা ভাত তার সাথে লাউ দিয়ে গরুর মাংস রান্না, ব্যস আর কিছু না। খুব আশাহত হলাম। বিড়বিড় করে বললাম – প্রেসিডেন্টরা এমনই হয়। নিজেরা ভাল ভাল খাবার খাবে আর জনগণকে লঙ্গরখানার খাওয়া খাইয়ে বিদায় করবে। বন্ধুর খোঁচা খেয়ে তাকিয়ে দেখি, প্রেসিডেন্ট জিয়া আমাদের সারিতে বসে নিজেও হাত ডুবিয়ে সেই লাউ মাংস আর ভাত খাচ্ছে।

বিশ্বাস করেন, সেদিনে থেকে আমি তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম। এত বড় মাপের হয়েও এমন সিম্পল মানুষ আমি জীবনে আর দেখি নাই।

আরেকবার প্রেসিডেন্টের বাসায় গেলাম সকালবেলায় পার্টির কাজে। বলা ছিল নাস্তা খাওয়াবে। সেদিন আর বেশী কিছু আশা করি নাই। তবে ভেবেছি নিদেনপক্ষে পরোটা ডিম ভাজি তো থাকবেই। না তাও ছিল না। সিমপ্লি পাতলা আটারুটি আর আলুভাজি খেয়েছি প্রেসিডেন্টের সাথে বসে। তারপর এক কাপ লাল চা।

শুধু ভাল খাবারের লোভে স্কুলের বন্ধু সাইদের বাসায় যেতাম ঘন ঘন। হলের প্রাণহীন খাবার খেয়ে পেটে চর পড়ে গেলে আমি সাইদের বাসায় গিয়ে দুপুর/রাত দুই বেলা খেয়ে আসতাম। তবে সবচেয়ে রাজকীয় খাবার খেয়েছি আব্বা মানে প্রিয় বন্ধু রহমতের বাসায়। খালাম্মা ‘নারসেগরিং’ নামে ইন্দোনেশিয়ান একটা ডিস বানাত। ওরে সে কি মজা সেই খাবার। অনেক ডিম আর চিকেনের ছোট ছোট পিস দেয়া ফ্রাইড রাইস। অসাধারণ সুন্দর একটা ফ্লেভার ছিল সেই রাইসের। বিলিভ ইট অর নট, আমি ঢাকায় গেলে শ্রদ্ধেয়া খালাম্মা এখনো আমাকে সেই খাবার রান্না করে খাওয়ান। কি কপাল আমার।

অন্য এলাকায় সাইনবোর্ড দেখলেও ঢুকি নাই কখনো। তখন মাত্র একটা দুইটা করে চাইনিজ রেস্তোরাঁ খুলতে শুরু করেছে এলিফ্যান্ট রোডে। এই খাবারের স্বাদ আবার এক্কেরে আলাদা টাইপের। একবার খাইলে বার বার খাইতে মন চায়। ওদের স্যুপ, ফ্রাইড চিকেন খেয়ে কখনো আশা পূরণ হত না। আরও বেশী বেশী খেতে ইচ্ছা করতো। আমাদের হলের বাউন্ডারির কোনায় কাঁটাবনে প্রথম এলো টাইকিং। এই রেস্তোরাঁ খোলার পর দেশী খাবার আর ভাল্লাগে না। খালি চাইনিজ খাইতে ভাল্লাগে। বন্ধুরা মিলে যাই। ভার্সিটির ছাত্র তাঁর উপর সুর্জসেনের বাসিন্দা বলে আমাদের জন্য খাবারের দাম নিত অর্ধেক। তাই খাইতাম যখন তখন।

অমন খাইতে খাইতে একদিন শুনি আমাদের ভার্সিটি লাইফ ফিনিতো মানে শেষ। যেতে নাহি মন চায়, তবুও ব্যাগ গোছায়ে মন খারাপ করে একদিন হল ছেড়ে বাসায় চলে এলাম।

এলাম বটে কিন্তু বাসায় থাকতে একটুও ভাল্লগাতো না আমার। বেশীদিন থাকি নাই। বছর তিনেক পর আমি দেশ ছেড়ে ভেগে গেলাম বিদেশে।

~ ছবিটা সুর্যসেন হলের ক্যাফেটারিয়াতে তোলা । ১৯৮৩ সালের কোন একদিন মনে হয়। ছবিতে আমরা চার ক্লাসমেট দুপুরের খাবার খাচ্ছি। বাম দিক থেকে বাচ্চু, আমি, কামাল, পিন্টু। পিন্টুর পাশে মেসিয়ার জুলহাস। তাকিয়ে দেখুন আমার প্লেটের সামনে এক হাফপ্লেট ভর্তি কাঁচামরিচ। তখনো খেতাম এখনো খাই কাঁচামরিচ ছাড়া ভাত গলা দিয়ে নামতে চায় না আমার।

২৪শে মার্চ, ২০১৯