কুহেলিকা
~ এক ~
সকালে স্কুলে যাবার পথে, বিকেলে বাসায় ফেরার সময় একই ভাবে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা। স্কুলে থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে কোচিং এ যেতে হয় সেই এক রাস্তা ধরেই । মেয়েটা অবাক হয়ে দেখ, তখনো ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে ল্যাম্প পোষ্টের পাশে। আড়চোখে লক্ষ করে আরো অবাক হলো, ছেলেটা ওর দিকেই তাকিয়ে থাকে।
ক্লাস নাইনে পড়ুয়া কুহেলিকা’র মনে সন্দেহের দানা বাঁধল। ছেলেটার নিশ্চয়ই ওর উপর নজর পড়েছে। এরপর থেকে স্কুলে যাওয়ার সময় ব্যাপারটা ভাল করে লক্ষ করা শুরু করলো সে। চোখা চোখি হলেই অন্যদিকে তাকায় ছেলেটা । কোন ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করে না। কিশোরী বয়সের কৌতুহল বশতঃ ক্লাসের প্রিয় বান্ধবীর সাথে ঘটনাটা আলোচনা করলো। বান্ধবী ছেলেটার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবে কথা দিলো।
বাসায় ফিরেও বার বার ছেলেটার কথা মনে পড়ে। মনের পর্দায় ভেসে উঠে সহজ সরল চেহারা নিয়ে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার মুখ। কেমন করে একটু একটু ভাল লাগার অনুভুতি অনুভব করতে শুরু করল কুহি।
এমন নয় যে এর আগে কেউ ওর দিকে তাকায় নাই, জ্বালাতন করে নাই। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম মনে হওয়ায় এমন ভিন্ন অনুভুতি হচ্ছে। বান্ধবী কেন এখনো কিছু জানাচ্ছে না, এটা মনে করে বিরক্ত লাগছে।
মার্কেটে গেলে, স্কুলের সামনে, কোচিং এ, বিয়ের অনুষ্ঠানে যে সব ছেলেরা নিজেদের খুব হিরো মনে করে কথা বলতে চেয়েছে, প্রেম করতে চেয়েছে , চিঠিও দিয়েছে এমন কাউকেই কুহি’র ভাল লাগে নাই। মনে হয়েছে ওরা সব বদের হাড্ডি। কারন, কুহি এর মধ্যেই জেনে গেছে এই ধরনের ছেলেরা বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে মেয়েদের সাথে প্রেমের অভিনয় করে। তারপর কাউন্ট করে কে কয়টা মেয়েকে পটাতে পেরেছে । তাই সে এদের সুন্দর চেহারা, পোষাক আশাক দেখে পাগল হয়ে যায় না।
সিলেট শহর থেকে অনেক ভিতরে মফস্বল শহরে থাকলেও এলাকায় কুহি’র পরিবার ভাল অবস্থাপন্ন। বাবার নাম ডাক আছে। বর্ষীয়ান মুরুব্বি হিসাবে এলাকার সবাই কুহির বাবাকে অনেক সন্মান করে। এলাকার যে কোন বিচার আচারে কুহির বাবাকেই সবাই পঞ্চায়েতের মত মানে। উনি যা সিদ্ধান্ত দেয়, সবাই সেটা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়।
পাঁচ বোনের মধ্যে কুহি তৃতীয়। বড়রা কেউ প্রেম করছে না। তাই অভিজ্ঞতা কম। বান্ধবী ছেলের সব খোঁজ খবর জোগাড় করে নিয়ে এলো। শুধু তাই নয়, সাথে নিয়ে এলো ছেলের একটা চিঠিও।
ছেলের নাম মাসুদ। টাঙ্গাইলের ছেলে। সিলেটে মামা বাড়িতে থেকে কলেজে পড়াশুনা করে । দেখতে ভালো, কথাবার্তায় ভদ্র। কখনো মুখ তুলে একটা কথাও বলে নাই। তাই এমনিতেই ছেলেটাকে ভাল লেগে গেছে। বান্ধবীকে খোঁজ নিতে পাঠিয়ে তার হাতে ছেলের চিঠি পেয়ে কুহি যতটা না অবাক হলো তারচেয়ে বেশি খুশিই হল মনে মনে ।
চিঠিতে অনেক কিছু লিখা ছিল না। যেন কেউ খুব ভয়ে আছে এমন ভাবে লিখা ‘তোমাকে আমার অনেক ভাল লাগে’। এই এক লাইন লিখাই কুহির মন জয় করে ফেলল। কিশোরীর মনে নীল প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করলো।
কুহেলিকা বান্ধবীর হাত দিয়েই মাসুদের চিঠির উত্তর দিলো কয়েকদিন পরে। লিখেছিলো ‘আপনাকেও আমার ভাল লাগে’।
তারপর খুব বেশি সময় লাগে নাই ওরা দু’জন দুজনার কাছা কাছি আসতে। চিঠি দেয়া দেয়ি থেকে লুকিয়ে দেখা করা শুরু হল। মনের কথা আদান প্রদান হল।
বছর ঘুরে গেল। কুহি’র এস,এস,সি পরিক্ষার সময় হয়ে এলো। কিন্তু মাসুদের তর সইছিলো না। সহসাই বিয়ে করে ফেলতে চাইলো। কুহি’র বিয়ের বয়স হয় নাই। তাছাড়া পরিক্ষা সামনে, তাই বেঁকে বসল। কিন্তু মাসুদ নাছোড়বান্দা। নিজের মামাকে দিয়ে কুহির বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে বসলো। কুহি’র বাবা এত তাড়াতাড়ি মেয়ের দিতে চাইলেন মা। তাছাড়া , কুহি’র মেজবোনের বিয়ে দেয়া তখনো বাকী।
এলাকার মুরুব্বি হিসেবে কারো ছেলে মেয়ের বিয়ে, পারিবারিক ঝামেলার জন্য মানুষ কুহি’র বাবার উপর নির্ভর করে সমাধানের জন্য । কিন্তু নিজের মেয়ের প্রেমের খবর জানা জানি হয়ে যাওয়ায় খুব বিব্রত হলেন ভদ্রলোক। শান্ত প্রকৃতির মানুষ কুহি’র বাবা এটা নিয়ে বাড়িতে কোন হই চই করলেন না। কিন্তু তখুনি বিয়ে দিতেও রাজি হলেন না।
মাসুদ এলাকার ছেলেদের পয়সা দিয়ে বশ করে দেয়ালে দেয়ালে মাসুদ-কুহি’র নামে যেমন ইচ্ছা রঙ চঙ্গে কাহিনী লিখাতে শুরু করলো । নিরুপায় হয়ে অপমানের হাত থেকে রক্ষা পেতে কুহি’র বাবা অল্প সময়ের ভিতরেই মাসুদের সাথে কুহি’র বিয়ে দিয়ে দিলো ।
সতের বছরের কুহেলিকা হয়ে গেলো ঘরের বউ । মাসুদের সাথে টাঙ্গাইলে শশুর বাড়িতে এলো । ভালই কাটছিল সময় টাঙ্গাইল আর সিলেটে যাতায়াত করে ।
বছর না যেতেই মাসুদের মাথায় বিদেশ যাবার ভুত চাপলো। দালাল ধরে শশুরের টাকায় গ্রীসে চলে গেলো মাসুদ একা ।
কুহি কলেজে ভর্তি হল। কিন্তু মনের ভিতর ইচ্ছা একটাই – কখন কেমন করে মাসুদের কাছে গ্রীসে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু চাইলেই তো আর যাওয়া যায় না। এমনিতেই বয়স অনেক কম, ভিসা পাবার কোন সম্ভাবনাই নাই। তার উপর মাসুদ চায় না এই মুহুর্ত্যে কুহি বিদেশে আসুক। অগত্যা এইচ,এস,সি পরিক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো, মনের ভিতর মাসুদের জন্য অনেক প্রতিক্ষা নিয়ে।
দুই বছর পর মাসুদ দেশে এলো বেড়াতে। কুহি’র আনন্দ আর ধরে না। মাসুদকে নেয়ার জন্য ঢাকায় এলো সিলেট থেকে। ফিরে যাবার পথে সারা রাস্তায় বক বক করে শুধু কথাই বলে গেল কুহি। ওকে কবে নিয়ে যাবে নিজের কাছে, ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলো। এই প্র্সংগ এলেই মাসুদ কথা এড়িয়ে যায়।
কুহি’র চাপা চাপিতে ওরা ইন্ডিয়ায় বেড়াতে গেলো তাজমহল দেখতে। কিন্তু কুহি কেন যেন আগের প্রানবন্ত মাসুদকে খুজে পাচ্ছিল না । মাসুদ অনেক বদলে গেছে। কুহি’র জন্য আগের মত পাগল পাগল ভাব নাই। চুপ চাপ, অন্যমনস্ক, অল্প কথাতেই রেগে যায়। মাসুদের এই পরিবর্তন কুহি’র ভাল লাগে নাই। বয়স কম হলেও কুহি’র বুদ্ধি অন্য দশটা সাধারন মেয়ের চাইতে অনেক বেশি। সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করলো ওর মনে।
কুহির চাপাচাপিতে মাসুদ যুক্তি দেখালো তার বর্তমান স্ট্যাটাস দিয়ে সে তাকে নিজের কাছে নিতে পারবে না এখন ।
ইন্ডিয়ায় তাজমহল দেখতে গিয়ে ভাগ্যক্রমে এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হল ওদের যিনি নিজেও গ্রীসে থাকেন। কুহি ভদ্রলোকের সাথে নিজের সমস্যার কথা আলোচনা করলো। সেই ভদ্রলোক যা নাম চুন্নু সাহেব – তিনি কুহিকে আশ্বস্থ করলো ঢাকায় ফিরে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সাহায্য করবে।
তাজমহল থেকে ঘুরে দেশে ফিরে কয়দিন পরেই মাসুদ ফিরে গেলো গ্রীসে। ততদিনে কুহি সন্তান সম্ভবা। স্বামীর কাছে যাবার তাগিদ বেশি করে অনুভব করলো। কুহি যোগাযোগ করলো চুন্নু সাহেবের সাথে। খুব আন্তরিকভাবেই বুদ্ধি, উপায়, এবং কাগজপত্র দিয়ে সাহায্য করল এই ভদ্রলোক কুহি’কে। বানানো এসব কাগজপত্র দেখিয়ে কুহি একদিন গ্রীসে যাবার ভিসা যোগাড় করে ফেলল। মাসুদকে আগেই জানানো হয়েছে কুহির প্রেগন্যান্সির কথা। ভিসা পাবার পর মাসুদের প্রথম শর্ত ছিল কুহিকে গ্রীসে যেতে হলে বেবি এবরশন করে ফেলতে হবে। যুক্তি ছিল বিদেশের প্রাথমিক সংগ্রামী জীবনে বাচ্চা থাকলে জীবন অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। কুহিও তার পরিবারের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ল। কিন্তু সে মাসুদের কাছে যেতে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি। তাই পাঁচ মাসের অন্তঃসত্তা কুহি এবরশন করে বাচ্চা বিসর্জন দিয়ে বিদেশে যাবার জন্য নিজেকে তৈরী করলো ।
~ দুই ~
যে মেয়ে কোনদিন ঠিকমত ঢাকা শহর দেখে নাই, প্লেনে উঠে নাই একদিন একা গ্রীস এর এথেন্সে এসে পৌছালো সিলেটের সেই কম বয়সী লাজুক কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ী মেয়ে ‘কুহেলিকা’। মাসুদের ভালবাসায় হয়ত খাদ ছিল কিন্তু কুহি সত্যি পাগলের মত ভালবাসতো মাসুদকে। কারো চাওয়া আন্তরিক,সৎ, বেপরোয়া হলে সব সম্ভব, সেটাই কুহি প্রমাণ করে দিল।
শুরু হোলো কুহেলিকা’র জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়।এথেন্স এর আলো ঝলমল সুন্দর এয়ারপোর্টে মাসুদকে অপেক্ষা করতে দেখে কুহি সব কষ্ট ভুলে গিয়ে দৌড়ে মাসুদের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। মাসুদের অনেক পুরনো লক্কর ঝক্কর গাড়িতে উঠেও কুহির খারাপ লাগে নাই। রাস্তার দুই পাশের সুন্দর গাছ পালা, ঘর বাড়ি,বিশাল অট্রালিকা দেখতে দেখতে এক সময় মাসুদের বাসায় এসে পৌছুল ওরা ।
আগেই বলেছি বিয়ের আগের স্বতস্ফুর্ত, কুহির জন্য দেওয়ানা মাসুদ আর বিয়ের পরের মাসুদ সম্পুর্ন ভিন্ন মানুষ। পার্থক্যটা বুঝতে পারলেও খুব খারাপ কিছু কল্পনা করে নাই কুহি। চাপা স্বভাবের ধরে নিয়ে মাসুদ ওখানে কেমন করে কোথায় থাকে এসব কিছুই আগে থেকে জানতো না কুহি। এথেন্সে এসে পৌছানোর পর যখন মাসুদ কুহিকে একটা বাসায় এনে তুলল যেখানে অন্য একটা ফ্যামিলি থাকে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে। সে বাসায় মাসুদের কোন আলাদা সাজানো গোছানো ঘর নাই – এমন দেখে কুহি’র মন ভেঙ্গে গেলো।
অনেক তপস্যা করে পাওয়া প্রেমিকা স্ত্রী আসছে দেশ থেকে তার জন্য মাসুদ কোন প্রস্তুতিই নেয় নাই এটা আরো বেশি অবাক করলো কুহিকে। অন্যের বাসায় শেয়ার করে থাকা তার উপর বিমাতা সুলভ আচরনের জন্য কুহি সেই বাসায় থাকতে রাজী হোল না।
আমরা আগেই জেনেছি কুহেলিকা অল্প বয়স থেকেই অনেক বেশি বুদ্ধিমান, জেদী এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার মানুষ। তার জেদের কারনে মাসুদ সেই বাসা ছেড়ে আরেক বাসায় গিয়ে উঠলো কুহিকে নিয়ে। সে বাসার অবস্থা আরো খারাপ। ছোট একটা বাসায় বেশ কয়জন ব্যাচেলর শেয়ার করে থাকে। মাসুদ আর কুহি’র জন্য আলাদা কোন ঘর ছিল না। তাই ওরা ঘুমাতো লিভিং রুমের ফ্লোরে। কুহি মাসুদকে ছোট হোক তবুও আলাদা একটা বাসা নিতে বলল। কিন্তু ম্যাগডোনাল্ড’স ফাস্ট ফুডে জব করে যে পয়সা পায় তা’ দিয়ে আলাদা বাসা নেয়া মাসুদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
দেশ থেকে আসার সময় কুহির বাবা বেশ ভাল অঙ্কের ইউরো কিনে দিয়েছিল ওকে, মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে। সে মাসুদকে জানালো তার কাছে তিন হাজার ইউরো আছে। শুধু তাই নয় , কুহি ওখানে কাজ করতেও মানসিকভাবে তৈরি। তবুও আলাদা বাসা চাই। কিন্তু মাসুদ কুহির কাজ করার আইডিয়া হেসেই উড়িয়ে দিলো।
কুহির সাথে করে আনা টাকা দিয়ে সামান্য ফার্নিচার কিনে ওরা ছোট একটা বাসা ভাড়া নিলো। মাসুদ কাজে চলে যায় কুহিকে বাসায় রেখে। কিন্তু কুহি বাসায় বসে থাকে না। বাইরে গিয়ে আশে পাশের মানুষের সাথে কথা বলে। গ্রোসারী কিনতে সুপার মার্কেটে যায়। পথে কোন বৃদ্ধ মানুষকে ভারী ব্যাগ বহন করে আনতে কষ্ট হচ্ছে দেখলে এগিয়ে গিয়ে ওদের ব্যাগ নিজের হুইল ট্রলিতে তুলে নিয়ে এগিয়ে দেয়। সুপার মার্কেটে যাবার আগে আশে পাশের বুড়িদের জিজ্ঞেস করে যায় কার কিছু লাগবে কিনা। ওরাও খুশি হয়ে ওদের জিনিস পত্র কুহিকে দিয়ে আনিয়ে নেয়। এভাবে প্রতিবেশিদের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠে কুহি অল্পদিনেই ।
পাশের একটা বাসায় কয়েক ঘন্টার জন্য বেবী সিটিং এর কাজও পেয়ে যায়। মাসুদ বাসায় ফেরার আগেই কুহি বাসায় ফিরে আসে। মাসুদ জানতেই পারে না কুহি কি করছে। তাই দিয়ে ছোট খাট কাজ করে যা পয়সা পায় তাই দিয়ে ঘরের জিনিসপত্র কিনে আনে ।
কুহির খুব সখ পড়াশুনা করার। নিজে খোজ খবর নিয়ে ভর্তিও হলো একটা কলেজে। কিন্তু টিউশন ফি চালাতে না পেরে সংসারে মন দেয়ার জন্য পড়া ছেড়ে দিয়ে কাজ খুজতে শুরু করলো। একদিন মাসুদের কাজের যায়গা ম্যাগডোনাল্ডস এ গিয়ে মাসুদের কাজ শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করছিল। মাসুদের মহিলা বস কুহিকে দেখে কথা বলল। কুহি অনেক হাসি খুশি, চটপটে মেয়ে। ওকে খুব পছন্দ হয় ম্যানেজারের। জিজ্ঞেস করে কাজ করবে কিনা। কুহি সানন্দে রাজি হয়ে গেলো। পরদিন থেকেই অন্য একটা ম্যাগডোনাল্ডস এ কুহির চাকরি জীবন আরম্ভ হয়ে গেলো ।
কাজ, কাজের পর রান্না, বাসা গোছানো, গ্রোসারী করা, লন্ড্রী করা, কোন কিছুতেই ক্লান্তি নাই কুহির। সপ্তাহ শেষে বেতনের টাকা পেলেই মাসুদ পুরোটাই চেয়ে নিয়ে নেয়।নিজের জন্য কিছুই রাখেনা। এত কিছুর পরও মাসুদের সাথে দুরত্ব না কমে বরং তিক্ততা বাড়তে থাকে। কুহি ততদিনে দুইটা জব, ছুটির দিনে পাশের বাসায় বেবি সিটিং এসব করে ভাল পয়সা আয় করতে শুরু করলো। আয়ের অংশ বিশেষ নিজের জন্য আলাদা করে সরিয়ে রেখে বাসার জিনিসপত্র কিনে আনতো।
মাসুদ হটাৎ কাজ ছেড়ে দিয়ে ঘোষনা করলো সে ব্যবসা করবে। ভাল একটা সুযোগ এসেছে। যাই বলে কুহি সব বিশ্বাস করে কারন ওর ধারনা বিদেশের কঠিন জীবন মাসুদকে কঠিন করে তুলেছে। একদিন দুইজনের পরিশ্রমের ফলে সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। তখন মাসুদ আবার আগের মত হাসি খুশি প্রেমময় হয়ে যাবে। সেই আশায় কুহি মাসুদ যা বলে ঠিক তাই করে যায় বিনা প্রতিবাদে।
মাসুদ জানালো সে একটা গ্রোসারী শপ কিনবে। তার জন্য টাকা দরকার। কুহি তার বাবাকে এই খবর জানালো। ব্যবসায়ী বাবা মেয়ে জামাই’র প্ল্যানে খুশি হয়ে পচিশ লাখ টাকা পাঠালো দেশ থেকে। মাসুদ কুহির নামে আরো ত্রিশ হাজার ইউরো লোন নিলো ব্যাঙ্ক থেকে।
মাসুদ ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার নতুন ব্যবসা নিয়ে। কুহি ব্যস্ত থাকল তার দুইটা জব, বেবি সিটিং, সংসার সাজানো নিয়ে। একদিন কাজ শেষ করে মাসুদের স্টোরে গিয়ে দেখে মাসুদ নাই। সামনে কম্পিউটার অন করা। কুহি তাকিয়ে দেখে মাসুদ ফেসবুকে কারো সাথে চ্যাট করছিলো। একটা মেয়েকে অনেক ভাল লাগা, ভালবাসার কথা লিখা। কিছুক্ষন পর মাসুদ ফিরে এসে কুহিকে দেখে একটু অবাক, তারপর বিরক্ত হল। তার উপর তার অন করে রেখে যাওয়া পি,সি দেখেছে সেজন্য আরো বিরক্ত। মেয়েটা কে জানতে জানতে মাসুদ হেসে উড়িয়ে দিল। বলল, ওসব জাষ্ট ফান। চিন্তার কিছুই নাই।
আলাদা বাসা, মাসুদের দরকারে সব রকম আর্থিক সাহায্য দেয়া, কুহি’র আয়ের বেশির ভাগ টাকাই মাসুদের হাতে দিয়ে দেয়া – তারপরও ওদের দু’জনের সম্পর্ক মধুর না হয়ে বরং দুরত্ব আর তিক্ততা বেড়েই চলছিল। এক বাসায় থেকেও ওরা স্বামী স্ত্রী’র সম্পর্ক নয়, রুম মেটের মত দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু সেখানে সব কিছুতেই মাসুদের আধিপত্য ছিল এবং কুহি সেটা মেনেও চলছিল ।
কাজ শেষ করে বাসায় এসে রান্না, খাওয়া শেষ করার পর কুহি’র আর কিছু করার ছিল না বাসায় কোন টিভি না থাকায় সময় কাটানোর আর কোন উপায় ছিল না। মাসুদ বাসায় ফিরে গভীর রাতে। তাই কুহি নিজের জমানো পয়সা দিয়ে একদিন একটা ল্যাপ টপ কিনে আনলো। দেশের কোন বান্ধবীর কাছ থেকে জেনে নিয়ে বাংলা চ্যাট লাইনে গিয়ে মানুষের বাংলা কথা, গান শোনা এসবে মন দিলো এবং বেশ মজা পাচ্ছিলো। আনন্দের আতিশয্যে নিজেও মাইক অন করে মাঝে মাঝে কথা বলে ফেলতো ।
একদিন অনেক রাতে মাসুদ বাসায় ফিরে কুহিকে কানে হেড ফোন লাগিয়ে খুব হাসা হাসি করা অবস্থায় পেয়ে মনে করলো কুহি তাঁকে লুকিয়ে অন্য কোন মানুষের সাথে প্রেম করছে। ব্যস, কোন কথা নাই। আছাড় মেরে ল্যাপটপ ভেঙ্গে ফেলল এবং কুহিকে অনেক মারধোর করলো। কুহি নীরবে সব সহ্য করলো।
সম্পর্কের দুরত্ব বেড়ে চলে। শারিরীক মানষিক কষ্ট বেড়েই চলে। কিন্তু তবুও দেশে নিজের বাবা মা, বোনদের কিছুই জানায় না। বরং সব কিছু ঠিক আছে, ভালই আছে এমন ধারনা দিয়ে যায়। কুহি চেষ্টা করে যাচ্ছিল, আশা করছিল একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
কোন কারনে একদিন সময়ের আগেই কাজ শেষ হয়ে যাওয়াতে কিছু খাবার কিনে নিয়ে কুহি মাসুদকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য আচমকা ওর ষ্টোরে গিয়ে হাজির। গিয়ে প্রচন্ড হোচট খেলো। দেখে মাসুদ একটা বিদেশী মেয়ের সাথে খুব ঢলা ঢলি করে গল্প করছে তার কাউন্টারের পিছনে দাঁড়িয়ে। মোটেই আশা করে নাই কুহি এই সময়ে এমন করে হাজির হতে পারে। তাই খুব অবাক হলো। তারপর কেন এখানে এসেছে এই বলে রাগে ফেটে পড়লো। মাসুদের বান্ধবী কুহি কে জানতে চাইলে মাসুদ তাকে তার মেইড সারভেন্ট হিসেবে পরিচয় দেয়।
রাতের বেলায় বাসায় ফিরলে এটা নিয়ে অনেক ঝগড়া, মারা মারি, আবার কুহির কম্পিউটার ভাঙ্গা হয়। অশান্তি চরমে পৌছালে কুহি এসব ঘটনা তার মা’কে জানায়। বাঙ্গালী মায়ের মন, সব সময় মনে করে বিয়ে হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। স্বামী স্ত্রী’র ঝগড়া, মারা মারি এসব নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই কুহি’কে ধৈর্যশীল হতে বলে বাচ্চা নেয়ার বুদ্ধি দেয়। কিন্তু বাচ্চা হবে কি করে ? ওরা তো আর স্বামী স্ত্রীর মত বাস করে না। এক ছাদের নীচে থাকা দুইজন দুই প্রান্তের মানুষ যাদের ভিতর কোন কেমিষ্ট্রি নাই। যেখানে কুহি একাই বাসার সব কিছু করে আর মাসুদ পেইড রুম মেটের মত খেয়ে দেয়ে আলাদা ঘরে ঘুমায়।
কুহি’র মনে সন্দেহের দানা ঘনীভুত হতে থাকে। স্ত্রী হিসেবে স্বামীকে নানারকম ভাবে আকর্ষন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বুঝতে পারলো তার প্রতি মাসুদের কোন আকর্ষন নাই আর। কুহি মনের দুঃখে নিজের কাজ আর অবসরে বাংলা চ্যাট রুমে সময় কাটিয়ে দিন পার করছিল। এমনি করে একদিন শরীর ভাল লাগছিল না তাই কাজ থেকে ‘সিক’ লাগছে জানিয়ে বাসায় চলে এলো রেষ্ট নিবে বলে।
বাসায় ফিরে এসে ওর মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়লো। বেড রুম থেকে মেয়ে মানুষের গলা শুনে কুহি ওদিকে গিয়ে যায়। বেড রুমের দরজা খুলে দেখে মাসুদ এবং তার ষ্টোরে দেখা সেই বিদেশী মেয়েটা কুহি’র বেডে বিবস্ত্র হয়ে খুব অন্তরঙ্গ অবস্থায় শুয়ে আছে। যেন কিছুই হয় নাই এমন ভাব করে মাসুদ কুহিকে বলল দরজা বন্ধ করে এখান থেকে চলে যেতে।
ঠিক সেই মুহুর্ত্যে কুহি বুঝে ফেলল, মাসুদের সাথে তার বৈবাহিক জীবনের ইতি ঘটে গেছে। এরপর থেকে কুহি আর আর কোন দিন মাসুদকে কিছু বলে না। কিছুদিন এক বাসায় কাটিয়েছে রুম মেটের মত। তারপর একদিন কুহি মাসুদ ও সেই বাসা -দূটোই ছেড়ে চলে গেল। উকিলের সাথে পরামর্শ করে একরোখা, জেদী কুহি অপমানের জ্বালায় জ্বলে মাসুদকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিল।
দেশে বিস্তারিত না জানিয়ে মাসুদের সাথে আর থাকা সম্ভব হবে না তাই ছাড়া ছাড়ি করে ফেলেছে জানিয়ে দিয়ে বিদেশের মাটিতে অফিসিয়ালী কুহি তার নিজের একার জীবন শুরু করলো ।
~ তিন ~
বিবাহিত হয়েও বিদেশের মাটিতে দুইটা বছর লিটারেলি একাই কাটিয়েছে কুহি। অনেক শারিরীক ও মানষিক অত্যাচার সয়েও শেষ রক্ষা হয়নি কুহি’র অনেক সাধের, নিজের পছন্দের প্রেমের বিয়ে। মাসুদ হয়তো বাসে নাই, কিন্তু কুহি সত্যিই তাকে ভালবেসেছিল। বাস্তব অবস্থায় পড়ে কুহি’র সরল মনের নির্মল ভালবাসা ঘৃনায় পরিনত হল।
প্রবাস জীবনের শুরু থেকেই কুহু একা চলতে শিখেছে। তাই অফিসিয়ালী একা হয়েও কুহি কোথাও আটকে যায় নাই। অপমান, মানুষের নীচতার বহিঃপ্রকাশ দেখে কুহি আরো কঠিন মানুষে পরিনত হল।
কখনো একা, কখনো কারো সাথে বাসা শেয়ার করে কুহি নিজের কাজ নিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছিল। উপার্জন ভাল, খরচ কম- তাই ভাল সেভিংস হচ্ছে। এথেন্স এ হাপিয়ে উঠলে কখনো সুইডেনের স্টকহোম, কখনো জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্টে চলে যায় কাজ করতে। ইয়োরপীয়ান ইউনিয়ন তৈরি লে এক ভিসায় ইউনিয়নের যে কোন দেশেই যাতায়াত, কাজ করা সহজ। তাই কুহির এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়াতে কোন বাধা ছিল না ।
একা একা চার বছর পার করে দিলো। মাসুদকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের নামে ব্যাঙ্ক থেকে নেয়া লোন এর টাকা শোধ করতে হলো। দেশ থেকে বাবা মা, বোনরা চাপ দিতে লাগলো আবার বিয়ে করার জন্য। কিন্তু কুহি এসব কথা কানেই তুলল না।
বিদেশে পড়ে থাকলেও দেশে নিজের কাছের মানুষদের সবার সাথে সব সময় ফোনে কথা বলে কুহি। এমন করে একদিন কথা বলছিল তার এক মামার সাথে। মামা তার খোজ খবর নেয়ার পর কুহিকে বলল, তার পরিচিত খুব ভাল, হ্যান্ডসাম, প্রতিষ্ঠিত একটা ছেলে আছে। কুহিকে অনুরোধ করল ছেলেটার সাথে কথা বলে দেখতে। মামাকে কুহি খুব পছন্দ করত। মামা’র পছন্দের উপর ওর আস্থাও আছে। এমনিতেই একা জীবন কাটাতে ক্লান্ত কুহি, তাই মামার অনুরোধের কাছে হার মানলো। কথা বলতে রাজি হল ছেলেটার সাথে ।
~ চার ~
কয়দিন পর কুহি’র মোবাইলে ফোন এলো বাংলাদেশ থেকে – অপরিচিত নাম্বার থেকে।কুহি’র মামার রেফারেন্স দিয়ে নিজের নাম বলল ‘রনি’।রনি’র সাথে কথা বলে কুহির ভাল লাগল। ভদ্র,অমায়িক, আন্তরিক, গুছিয়ে কথা বলে রনি। দু’জনের আগ্রহে প্রতিদিন কথা বলা শুরু।
ফেসবুকে চ্যাট, যখন তখন কথা বলতে বলতে ওরা খুব আপন হয়ে গেলো একে অপরের।
সে বছর কুহির বাবার শরীর খারাপ হওয়ায় কুহির দেশে যাওয়ার প্ল্যান ছিল। রনির সাথে পরিচয় হয়ে যাওয়ায় সেই যাওয়া আরো এগিয়ে গেলো।
বাবাকে দেখতে কুহি দেশে ফিরে এলো। অন্যদের সাথে রনিও এলো এয়ারপোর্টে কুহিকে নিতে।রনি’র হাসি মুখ দেখে কুহির মন ভরে গেলো ।
মামার মুখে রনির কথা এবং কুহিরও পছন্দ হয়েছে জেনে কুহির বাবা মেয়েকে বিয়ের কথা বললেন। মেয়ে একা বিদেশ বিভুইয়ে থাকে এটা ভদ্রলোকের মোটেও পছন্দ নয়।
ব্রাম্মনবাড়িয়ার ছেলে রনি’রা দুই ভাই এক বোন। রনি সবার ছোট। কম্পিউটারের ব্যবসা করে দুই ভাই মিলে।
কুহিকে রনির পরিবার খুব পছন্দ করলো। এক রকম তাড়াহুড়া করেই বিয়ে হয়ে গেলো ওদের। রনির বাসায় কুহির এতই আদর সন্মান যে সবাই ওকে পারলে মাথায় তুলে রাখে।ছোট বড় সবাই সারাক্ষন কুহিকে ঘিরে রাখে, খেয়াল রাখে কখন কি লাগবে। ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠেই দেখে ‘বেড টি’ হাজির। এত আদরে কুহিও মুগ্ধ হয়। বিদেশে ফিরে যেতে মন চাইছিল না।
কুহির ইচ্ছা ছিল দেশে থেকে গিয়ে সংসার করতে, মা হতে। কিন্তু রনির ইচ্ছা কুহি বিদেশেই থাকুক। সম্ভব হলে রনিও চলে যাবে এক সময়। পছন্দের প্রেমিক পুরুষ স্বামীর কথা শিরোধার্য করে কিছুদিন একসাথে কাটিয়ে কুহি ফিরে গেলো এথেন্সে।
ফিরে গেলেও কুহির মন পড়ে থাকল দেশে রনির কাছে। কুহি নয়, রনিই সারাক্ষন ফোন করে দেশ থেকে কুহিকে কতটা মিস করে, জানায়।
কিছুদিন যেতেই রনি তার ব্যবসা বাড়ানোর জন্য কুহির কাছে টাকা চায়। বলে যে খুব ভাল একটা সুযোগ এসেছে ঢাকায় একটা ব্যবসা কেনার। কুহি কিছু না ভেবেই পাঁচ লক্ষ টাকা পাঠায় রনির জন্য। রনি সত্যিই ঢাকার উত্তরায় পার্টনারশীপে আরেকটা ব্যবসা কিনে। ছয় মাস না যেতেই কুহি দেশে ফিরতে চায় কিন্তু রনি বাধা দেয়। বলে এত ঘন ঘন আসলে টাকার অপচয় হবে। সেই টাকা ব্যবসায় ইনভেষ্ট করলে ব্যবসার উনতি হবে এমন কথাই বলল রনি।
বছরের শেষে কুহি একদিন তার মোবাইলে দেশ থেকে একটা কল পায় । মহিলা কন্ঠের কেউ ফোন করে কুহিকে জানায় সে রনি’র স্ত্রী। অনুরোধ করে কুহি যেন রনি’কে ছেড়ে দেয়। কুহি হাল্কাভাবে নেয় ব্যাপারটা। যদিও ব্যাপারটা মাথার ভিতর ঘুর ঘুর করতে থাকে। কুহি মহিলার কথা বিশ্বাস করে না। সে যে সত্যি কথা বলছে তার প্রমান চায়। তখন মহিলা জানায়, এরপর রনি যখন বাসায় আসবে , সে ফোন অন করে রেখে তাদের কথা বার্তা শোনাবে। এই কথায় কুহির টনক নড়ে।
কয়দিন পর সত্যিই সেই মহিলা ফোন করে রনির উপস্থিতি প্রমাণ করে দেয়। শোনায় রনির সাথে তার খুব আন্তরিক কথা বার্তা। এরপরও কুহি নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে। রনিকে সে কিছুই বুঝতে দেয়না। কিন্তু নিজের মনে সন্দেহের দানা বাধতে শুরু করলো। মনে পড়ল মাসুদ কেমন করে তাকে ঠকিয়ে অন্য মেয়েদের সাথে মিশতো।
কুহি দেশে আসে হটাৎ করেই। এসে রনির উত্তরার বাসায় উঠে। সেখানে আবার কল পায় সেই মহিলার কাছ থেকে যে নিজেকে রনি’র স্ত্রী বলে দাবী করে। অনুরোধ করে, কুহি যেন তার সর্বনাশ না করে। সে খুব গরিব ঘরের মেয়ে। রনি টের পেলে তার সব খরচ বন্ধ করে দিবে।
রনিকে খুব ভাল করে খেয়াল করতে শুরু করে কুহি। কুহিকে একা রেখে রনি প্রায়ই কয়েক ঘন্টার জন্য গায়েব হয়ে যায়। তখন রনির মোবাইলও বন্ধ থাকে সেই সময়ে কুহি সেই মহিলার নাম্বারে ডায়াল করে জানতে চায় রনি তার ওখানে আছে কিনা। যখন জানতে পারে রনি ওখানেই আছে – সব বুঝতে পেরে কুহির মাথায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। কুহি বুঝতে পারে সে আবার ঠকেছে। এটাও বুঝে ফেলেছে,রনি শুধুই তাকে টাকার গাছ হিসাবে ব্যবহার করছে, আর কিছুই নয়।
একদিন সকালে রনি কুহির কাছে টাকা চাইল। জানালো, বিদেশ থেকে তার ব্যবসার মাল এসেছে। ছাড়াতে অনেক টাকা লাগবে। কুহি যদি এখন দেয়, পরে সে শো্ধ করে দিবে। কুহি জানালো তার কাছে কোন টাকা নাই। ব্যাগ হাতিয়ে মাত্র পঞ্ছাশ ইউরো পেয়ে রনি অবাক হয়ে গেলো। বুঝলো, আর টাকা পাওয়া যাবে না। তবুও অভিনয় চালিয়ে যেতে থাকল।
ছোটবেলা থেকে কুহি প্রচন্ড জেদী মেয়ে। রেগে গেলে তাকে কেউ সামলাতে পারতো না।
তার নিজের সিদ্ধান্তেই সে দুইবার বিয়ে করেছে এবং দুইজনেই তাকে ঠকিয়েছে। এটা বুঝতে পেরে নিজের উপর খুব রেগে গেলো সে। সিলেটে নিজের বাড়িতে ফোন করে মা,বোনদের সব কিছু জানালো। কিন্তু ওরা কেউ এসব বিশ্বাস করতে চাইলো না। উলটা রনির পক্ষ হয়ে ওকে বুঝাতে চাইলো। বলল, তুমি বিদেশে থাকো, তাই কেউ হয়ত তোমাকে ফোন করে ত্যাক্ত করছে হিংসায়। আরো বুঝালো, শশুরবাড়িতে গিয়ে থাকো। ভাল লাগবে।
অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে কুহির। তাই সে বুঝে ফেলেছে যা জেনেছে, মিথ্যা নয়।
রনির সাথে ব্রাহ্মনবাড়ীয়া শশুরবাড়িতে গেলো। রনিকে সব জিজ্ঞেস করল, প্রথমে ঠান্ডা মাথায়। পরে উত্তেজিত হয়ে। রনি সব কিছুই হেসে উড়িয়ে দিলো। কুহি তার শশুর শাশুড়িকে সব জানালো। তারাও এসব কিছু বিশ্বাস করলো না। উলটা বলল, রনি এমন ছেলেই নয়।
ছোটবেলা থেকেই রেগে গেলে জিনিসপত্র ভাংচুর করার অভ্যাস আছে কুহির। কুহিকে ঠকিয়েও রনি এত নির্বিকার, স্বাভাবিক আছে দেখে কুহি নিজেকে আর থামিয়ে রাখতে পারছিল না। একদিন সকাল বেলায় নাস্তার টেবিলে কথা কাটাকাটি শুরু হলে কুহি প্লেট গ্লাস ভাঙ্গা শুরু করলো। সবাই দৌড়ে এলো কুহিকে থামাতে। কিন্তু কুহিকে তখন থামানো অনেক কঠিন। তার মাথায় রক্ত চেপে গেছে অপমানের জ্বালায়।
কুহির এমন অদ্ভুত আচরন দেখে রনি বলে উঠলো, ওকে ভুতে ধরেছে। ওর চিকিৎসা করাতে হবে। এই বলে কুহি’র মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে তাকে ঘরের ভিতর তালা বন্ধ করে রাখলো।
ভুত ছাড়ানোর জন্য খনকার ( ভুত ছাড়ানোর গ্রাম্য চিকিতসক) ডাকা হোলো।
খনকার ওকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে, কোত্থেকে আইসস? নিজে নিজে যাবি নাকি পিটায়া তোর ছাল ছামড়া উঠাবো ?
কুহি উত্তর দেয়, ‘আমি ঠিক আছি, আমার কিছু হয় নাই। আয় পিটায়ে তোর ভুত ছাড়াই।”
এমন কথা শুনে সবাই মাথা নেড়ে সায় দেয় যে কুহিকে আসোলেই ভুতে ধরেছে এবং সেটা খুব খারাপ ভুত।
কুহির হাত পা শেকল দিয়ে আটকানো হয়।
খনকার তার চুলের মুঠি ধরে ঝাকায় আর গালি দিয়ে দিয়ে বলে,’শয়তান, তুই আপোষে যাবি নাকি আমাকে আরো কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে?’
তারপর জুতা, ঝাড়ু এসব দিয়ে যথেচ্ছা মারে কুহিকে মার খেতে খেতে এক সময় কুহি জ্ঞ্যান হারিয়ে পড়ে যায়। তখন তাকে শেকল পরানো অবস্থাতেই ঘরের ভিতর তালা মেরে রেখে ওরা চলে যায় ।
জ্ঞান ফিরে এলে কুহি বুঝতে পারে যেমন করে হোক এখান থেকে পালাতে হবে নইলে তাকে পাগল সাব্যস্থ করে অনেক অত্যাচার করা হবে। শশুরবাড়িতে কুহির একমাত্র শুভাকাঙ্খী ছিল কুহির জা মানে রনির ভাই এর স্ত্রী। রনির ভাই শারিরীকভাবে কিছুটা বিকলাংগ। তাই গ্রামের খুব সাধারন ঘরের এক নিরীহ মেয়েকে তার তার সাথে বিয়ে দেয়া হয়। কুহি এই মেয়েকে খুব পছন্দ করত। বিদেশ থেকে তার জন্য সুন্দর মেয়েলী গিফট এনে দিত। ওর সাথে বন্ধুর মত গল্প করত।
কুহির জন্য খাবার নিয়ে তার ঘরের তালা খুলে ঢুকত তার জা। সে রনির চরিত্র সম্পর্কে আগে হেকেই জানত। কিন্তু কখনোই মুখ খোলে নাই ভয়ে। কিন্তু কুহির এই করুন অবস্থা দেখে সে বুঝে ফেলেছে তার আসোলে কিছুই হয় নাই। তাকে অন্যায়ভাবে আটকে অত্যাচার করা হচ্ছে। খাবার নিয়ে তার ঘরে ঢুকে সে কুহিকে মোবাইল দিয়ে সিলেটে বাপের বাড়িতে কথা বলতে বলল।
কুহি তার মা আর বোনদের সব জানালো। সমস্যা হল, কুহির প্রচন্ড রাগের কারনে তারাও ভাবলো কুহির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আসোলে কুহি দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় দেশের আত্মীয়দের সাথেও অনেক দুরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। কেউই তাকে ঠিক মত বুঝতে পারে না। তবুও তারা রনিকে অনুরোধ করল কুহিকে সিলেটে দিয়ে যেতে ।
রনি এই শর্তে রাজি হলো যে কুহির চিকিৎসা চলছে এখানে। তাই কয়দিনের জন্য রনি ওকে সিলেটে নিয়ে যাবে আবার তার সাথে ফিরে আসতে হবে। এই শর্তে কুহি গেলো সিলেটে তার বাপের বাড়িত। বাবা ততদিনে আর বেঁচে নাই। ওখানে গিয়ে কুহি সুযোগ পেয়েই ঢাকায় তার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করল। ঢাকায় গিয়ে কয়দিন ওদের বাসায় থাকার কথা জানালো। তারপর যোগাযোগ করলো জার্মানীতে তার বন্ধু ম্যাথিয়াসের সাথে।
ম্যাথিয়াসের সাথে কুহির পরিচয় হয় এথেন্সে। জার্মানীর ছেলে সফটঅয়ার ইঞ্জিনিয়ার ম্যাথিয়াস তার পেশাগত কাজে এথেন্সে গিয়ে কুহি’র কর্মস্থল ‘কফি শপে’ খেতে যায়। কুহি তার অর্ডার অনুযায়ী খাবার সার্ভ করে তার সাথে কথাও বলছিল দুষ্টামির ছলে ।
ম্যাথিয়াস বলছিল, ‘ Wow! You are so beautiful !!’
কুহিও কম যায়না। সেও ঠাট্টাচ্ছলে বলে, Do you really think so ? Then lets get married. We can have a beautiful color baby together.”
ম্যাথিয়াস তিন দিন কুহির কফি শপে খেতে আসে। খাবারের ফাকে ফাকে কথা হয়, গল্প হয়। তারপর বন্ধুত্বের অফার। ফোন নাম্বার দেয়া নেয়া হয়। ইমেইল, ফেইসবুকের ঠিকানাও দেয়া নেয়া হয় ।
ম্যাথিয়াস জার্মানীতে ফিরে গিয়ে কুহিকে ফোন করে, ইমেইল করে। নিছক নির্মল বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ম্যাথিয়াসের আমন্ত্রনে কুহি জার্মানীতে যায় এক সামারে। তিন মাস কুহি বেবি সিটিং এর কাজ করে ম্যাথিয়াসের ভাইএর বাচ্চার। বন্ধুত্ব হয় ম্যাথিয়াসের পুরো পরিবারের সাথে। সবাই খুব ভালভাবে গ্রহন করে কুহিকে। অনেক আদর, ভালবাসা নিয়ে তিন মাস কাটিয়ে কুহি ফিরে যায় এথেন্সে। আসার সময় কুহি তার ওখানে আয় করা সব টাকা ম্যাথিয়াসের কাছে রেখে আসে। বলে আসে, সে দেশে যাবে স্বামীর কাছে। প্রয়োজন হলে তাকে ফোন করে টাকা পাঠাতে বলবে।
ম্যাথিয়াস জানে কুহি বিবাহিতা। তাই সে তাকে সেভাবেই সন্মান করে। বজায় রাখে সুন্দর বন্ধুত্ব।
সিলেট থেকে কুহি ম্যাথিয়াসকে ফোন করে জানায় তার বিপদের কথা। তারপর জানায় ম্যাথিয়াস যেন তার জন্য একটা প্লেনের টিকেট করে পাঠায় সাথে কিছু টাকা। তারপর রনি কুহিকে নিয়ে আবার চলে যায় ব্রাম্মনবাড়িয়ায়। আবার সেই বন্দী অবস্থা। কুহি তার পালাবার সব প্ল্যান করে ফেলে দেবরের স্ত্রীর সহযোগিতায়। সেই গাড়ি ঠিক করে দেয়।
তারপর একদিন রনি যখন ঢাকায় গেল, জা তালা খুলে দিলে কুহি পালালো শশুরবাড়ি থেকে ঢাকায়।
ঢাকায় এসে বান্ধবীর বাসায় উঠল। কয়দিন শুধু ঘুমিয়ে কাটালো। তারপর বিদেশে ফিরে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগলো। উকিলের কাছে গিয়ে রনিকে ডিভোর্স লেটার পাঠালো। সিলেটে ফোন করে সেই খবরটা জানিয়ে দিল। তারপর ফিরে গেল এথেন্সে ।
মাসুদের সাথে ছাড়াছাড়ির পর প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোন দিন বিয়ে করবে না। একা জীবন কাটাচ্ছিল হেসে খেলে, ঘুরে ফিরে এবং ভালই লাগছিল সেই জীবন। সেই জীবনে কারো কোন চোখ রাঙ্গানি ছিল না। ছিল না কোন খবরদারি। যদিও দিনের শেষে ঘরে ফিরে এলে একাকীত্ব কুরে কুরে খেতো। সেজন্যই চার বছর একা কাটানোর পর নিজের মামা যখন রনির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, ভেবেছিল ভালই হয়। মন্দ কি ! কিন্তু যেই লাউ,সেই কদু !! আবারও সে ভুল করে বসলো মানুষ চিনতে। রনির হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরে এবার সত্যিই প্রতিজ্ঞা করে ফেলল আর কোন দিন দেশে ফিরে যাবে না। ফিরেও তাকাবে না কোন বাঙ্গালী ছেলের দিকে।
এথেন্সে ফিরে এসে কুহি তার জীবন আবার গোছাতে ব্যস্ত হোলো। শরীর মন বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো, ভঙ্গুর। চমকে উঠে ঘুমের ঘোরে দেশের অত্যাচারের কথা মনে হলে। কুহির ট্রাজেডির গল্প শুনে ফ্রাঙ্কফুর্টে বেড়াতে যেতে আহবান করলো ম্যাথিয়াস। কুহিরও খুব দরকার ছিল একটা ভাল ভ্যাকেশনের। তাই অফার ফিরিয়ে না দিয়ে কুহি চলে গেলো ফ্র্যাঙ্কফুর্টে।
~ পাঁচ ~
ম্যাথিয়াসের পরিবারের সাথে কুহির পরিচয় হয়েছিল এর আগে জার্মানীতে যখন কাজ করতে এসেছিল। ইন ফ্যাক্ট, ম্যাথিয়াসের ভাইএর ছেলের বেবি সিটার ছিল কুহি। তাই এবার যখন বেড়াতে এলো, ম্যাথিয়াসের পরিবার অনেক খুশি হল কুহিকে দেখে। ম্যাথিয়াসের বাবা মা আলাদা থাকেন। কিন্তু একই বিল্ডিঙের নীচতলায়। তারা কুহির রান্নার খুব ভক্ত। তাই কুহিকে দেখে তারা সাদরেই গ্রহন করল।
একদিন ম্যাথিয়াস কুহিকে নিয়ে ডিনারে গেল। খাবারের এক পর্যায়ে অনেক ভদ্রভাবে খুব ভয়ে ভয়ে কুহির সামনে হাটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করল, কুহির কি তাঁকে বিয়ে করতে কোন আপত্তি আছে কিনা ! এই পরিস্থিতির জন্য কুহি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ম্যাথিয়াস তার খুব ভাল আর বিশ্বস্থ বন্ধু। সে তাকে খুব পছন্দ করে কিন্তু ঘুর্নাক্ষরেও ভাবে নাই তাদের বন্ধুত্ব এই দিকে মোড় নিবে। ম্যাথিয়াসের মত এত সুশিক্ষিত, সুদর্শন ব্যাচেলর তার মত বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে যে কিনা মাত্র একটা তিক্ত বিয়ের বন্ধন থেকে পালিয়ে বেঁচেছে।
ম্যাথিয়াসের এত আন্তরিক আহবানে কুহি প্রথমে বিহবল, কিন্তু পর মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবল, এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে তার জীবনে। অনেক দিন ধরে সে ম্যাথিয়াসকে চেনে। তার ভিতর কখনোই কোন বাড়া বাড়ি, ছেলে মানুষী, আদিখ্যেতা দেখে নাই। বরং তার চোখে দেখেছে কুহির জন্য অনেক আন্তরিকতা, সন্মান। তাই কুহি ম্যাথিয়াসকে টেনে উঠালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমার সব কিছু জেনেও আমাকে বিয়ে করে সুখী হতে পারবে? ম্যাথিয়াসের উত্তর ছিল, আমি তোমার অতীত নিয়ে মোটেও আগ্রহী নই। আমি তোমাকে যেভাবে চিনি, তোমাকে নিয়ে সুখী হতে আমার কোন সমস্যা হবে না। তখন কুহি তার চোখে চোখ রেখে সম্মতি দিল।
শর্ত জানালো তার পক্ষে ধর্মান্তরিত হওয়া সম্ভব নয় কিন্তু সে ম্যাথিয়াসকে বিয়ে করবে যদি সে মুসলিম হয়। ম্যাথিয়াস এই কথা শুনে হেসে দিল। কারন অনেকদিন ধরেই কুহিকে চেনে ম্যাথিয়াস। তার মন মানসিকতা সম্পর্কে ভাল ধারনা আছে তার। তাই সে কুহিকে জানালো, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে – ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হবে।কারন সে কুহিকে অনেক বেশি পছন্দ করে, তার জন্য এই ত্যাগ টুকু করতে সে প্রস্তুত। কুহি বুঝতে পারলো, এত দিনে সে মনে হয় সত্যিকারের মানুষের হাতে পড়েছে।
ম্যাথিয়াস এলাকার টার্কিশ মসজিদে গিয়ে মুসলমান হল। নামায পড়া শিখলো। ইংরেজী কোরান শরীফ কিনে পড়তে শুরু করলো। কুহি তাকে ধর্মীয় নিয়ম কানুন, বাংলা ভাষা শেখালো।
ম্যাথিয়াসের বাবা অনেক লিবারেল মানুষ। ছেলের কোন সিদ্ধান্তে বাধা দেয় নাই কখনো। ছেলে যখন ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান মেয়ে বিয়ে করার কথা জানালো, তার বাবা আপতি করে নাই । শুধু জানালো যেন কখনো কোন অবস্থাতেই না জেনে অন্ধের মত কিছু করে না বসে ।
ম্যাথিয়াসের পরিবার ও শুভাকাংখীদের উপস্থিতিতে একদিন ওদের বিয়ে হয়ে গেলো। ম্যাথিয়াসের ফ্ল্যাটে কুহির নতুন জীবন শুরু হোলো।
~ ছয় ~
কুহি ও ম্যাথিয়াসের সংসার ভালই চলছে। ছয় মাস পরেই কুহি তার বরকে নিয়ে দেশে বেড়াতে গেলো। কুহির পরিবারের সবাই ম্যাথিয়াসকে খুব আনন্দের সাথে গ্রহন করলো। পাঞ্জাবী লুঙ্গি পরে মসজিদে যায় নামায পড়তে। হুজুরদের বয়ান শুনে ভুল কিছু শুনলেই হাত তুলে প্রতিবাদ জানায় । বলে, কোর’আনে এভাবে বলা নাই। সুরার আয়াত এবং ব্যাখ্যাসহ বলে দেয়। গরীব মানুষ দেখলেই টাকা দেয়। নিজে কারো কাছ থেকে কোন উপহার গ্রহন করে নাই। বলে, আমাকে না দিয়ে এই উপহার গরীব মানুষদের দিলে ওদের অনেক উপকার হবে। কিছুদিন সিলেটে কাটিয়ে আত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশী সবার মন জয় করে একদিন ওরা ফিরে গেলো জার্মানীতে ।
বছর ঘুরতেই কুহির অনেক দিনের মনোবাসনা পুর্ন করে ওদের ঘর আলো করে এলো ওদের ছেলে সন্তান। নাম রাখা হোল জাকারিয়া। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, রাতের বেলায় শিশু জাকারিয়া ঘুম থেকে জেগে উঠলে কুহিকে ঘুমাতে দিয়ে ম্যাথিয়াস উঠে তাদের ছেলের দেখা শুনা করে।
নতুন জীবনে কুহি এখনো বাইরে গিয়ে কোন কাজ করে না। বরং বাসায় থেকে বাঙ্গালী মায়ের মত ছেলের সাথে সময় কাটায়। স্বামীর জন্য রান্না করে অপেক্ষা করে। ম্যাথিয়াস বিকেলে ঘরে ফিরে এলে ওরা একসাথে খেতে বসে। ছুটির দিনে জাকারিয়াকে স্ট্রলারে বসিয়ে নিয়ে ওরা তিনজন বাইরে বেড়াতে যায়। রাস্তা ঘাটে মিশ্র রঙের দম্পতি সাথে শিশু দেখে মানুষ অবাক হয়ে তাকায় কিন্তু হাসিমুখে হাত তুলে শুভেচ্ছা জানায়। হটাত কোন বাঙ্গালীর সাথে দেখা হয়ে গেলে ওরা হাত নাড়তে ভুলে গিয়ে চোখে অবিশ্বাস নিয়ে হা করে তাকিয়েই থাকে। মনে মনে হয়ত ভাবে, মেয়েটা নিশ্চয়ই এই দেশে থাকার কাগজের জন্য এই ছেলেকে বিয়ে করেছে। ওরা ঘুর্নাক্ষরেও ভাবতে পারে না যে কুহি ও ম্যাথিয়াস একে অপরকে পাগলের মত ভালবাসে। সেখানে এক বিন্দু খাদনাই ।
অবশেষে, কুহি হয়তো খুজে পেয়েছে তার শান্তি আর ভালবাসার নীড়।
অনেক ভাল থাকুক ওরা, আজীবন!!
( পরিচিত একজন বাঙ্গালী নারীর সংগ্রামী জীবনের সত্যি ঘটনার উপর ভিত্তি করে লেখা এই গল্প )
মুরাদ হাই, নিউইয়র্ক
২০ জানুয়ারী, ২০১৫।